দেলোয়ার তার বউকে নিয়ে সরাসরি আমার ঘরে ঢোকে। এই প্রথম কোনো নারী ঢোকে আমার ঘরে;–আমার ছোটো বোনটি আর মা সব সময়ই আমার ঘরে ঢোকে, একবার একটি সহপাঠিনীও এসেছিলো; কিন্তু আমার মনে হয় এই প্রথম কোনো নারী আমার ঘরে ঢুকলো। আমার ঘরটি বদলে যায়, সিলিংয়ের এককোণে মাকড়সার জালটি সোনার তন্তুমালার মতো ঝলমল করে ওঠে। আমি লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করি, কিন্তু পেরে উঠি না; দেলোয়ারের বউ তাতে খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওই হাসি শুনে আমার মনে হয় আমি অজস্র অপরাধ করে ফেলেছি, তবে সেগুলো ক্ষমার অযোগ্য নয়; অন্যরা না হলেও ডলি সেগুলো অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়ে সুখ পাচ্ছে। ডলি ক্ষমা করে দিলেও আমি অজস্র অপরাধের ভার বোধ করতে থাকি। আমার ভেতরে একটি পুরোনো অপবিত্রতার বোধও জেগে ওঠে। তারা দুজনেই আমাকে নির্দেশ দেয় তাড়াতাড়ি উঠতে, এবং তাদের সাথে যেতে। আমি কোনো প্রশ্ন করি না–প্রশ্ন করলেই আমার অপরাধ বাড়বে মনে হয়; উঠে আমি নিজেকে তৈরি করে নিই, এবং তাদের সাথে বেরিয়ে পড়ি। আমি গাড়ির পেছনের সিটে বসতে চাই, ডলি বসতে দেয় না; সে-ই উঠে পেছনের সিটে বসে; সম্ভবত একটি পুরুষকে পেছনের সিটে বসিয়ে নিজে একটি পুরুষের পাশে বসতে তার দ্বিধা হয়। আমি সামনের সিটে বসি; দেলোয়ার গাড়ি চালাতে শুরু করে।
গাড়িতে উঠে আমি জানতে পারি তারা আমাকে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর দেলোয়ার এই প্রথম যাচ্ছে ডলিদের গ্রামের বাড়ি; অন্যরা সবাই চলে গেছে, এর মাঝে দেলোয়ার আর ডলিও হয়তো গিয়ে পৌঁছোতো; কিন্তু বাসা থেকে বেরিয়ে আমার কথা মনে পড়ে দেলোয়ারের। আমাকে চমকে দেয়ার জন্যে তারা ঠিক করে আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে; আমি রাজি না হলেও তারা শুনবে না। আমি টের পাই গাড়িটা পুরোপুরি সুগন্ধে ভরে আছে। পেছনের সিট থেকে কোমল মাংসের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া সুগন্ধ এসে আমার নাকে লাগতে থাকে। বেশি সুগন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে; কিন্তু আমি খুব আনন্দে রয়েছি এমনভাবে বসে থাকি। এক সময় আমার মনে হয় গাড়ি সুগন্ধে নয়, মাংসের গন্ধে ভরে উঠছে, সোনালি মাংসের ভেতর থেকে গন্ধ উঠে আসছে; তখন গাড়ি থেকে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়তে আমার ইচ্ছে হয়। দেলোয়ার গাড়ি চালাচ্ছে, আর অনবরত কথা বলছে, আর ডলি অনবরত হেসে চলছে; ডলির হাসির শব্দও আমার কাছে মাংসে গঠিত বলে মনে হয়। ডলির দিকে পেছন ফিরে একবারও আমি তাকাই নি, কিন্তু তার হাসি শুনে আমি বুঝতে পারি সম্ভব হলে সে গাড়ি ভ’রে মাংস ছড়িয়ে দিতো; তাল তাল মাংসের গোলাপ ফুটিয়ে তুলতে গাড়ি জুড়ে। ডলি এখন পুরোপুরি মাংস। আমি ভয়ঙ্কর মাংসের গন্ধ পেতে থাকি; নারায়ণগঞ্জ নামের একটি শহরের কথা আমার মনে পড়ে; ইচ্ছে হয় দেলোয়ারকে গাড়ি থামাতে বলি, বাইরে গিয়ে অনেকক্ষণ নিশ্বাস নিই; কিন্তু দেলোয়ারকে আমি গাড়ি থামাতে বলতে পারি না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ফেরিঘাটে পৌঁছি। শহরের সব লোক সম্ভবত বাস ট্রাক বেবি জিপ গাড়ি করে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে; হয়তো শহরে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে, বা শহরে মড়ক লেগেছে, বা আজই শহর ভ’রে প্লেগ দেখা দেবে, এমন ভিড় ফেরিঘাটে; তবে দেলোয়ার চমৎকার গাড়ি চালাতে জানে-সে একটির পর একটি গাড়ি পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এক সময় তাকেও থামতে হয়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, বারবার নেমে পড়ার প্রচণ্ড চাপ বোধ করছিলাম; কিন্তু নেমে পড়া ঠিক হবে কি না আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দুটি জিনিশ কঠোর পীড়া দিচ্ছিলো আমাকে;–মাংসমেশানো সুগন্ধে আমার দম আটকে আসছিলো, আর গাড়িতে বসে ফেরিতে ওঠার ভয় পেয়ে বসছিলো আমাকে। আমি তা প্রকাশ করতে পারছিলাম না। আমি কী করে প্রকাশ করি যে বন্ধুর নতুন বউর শরীর থেকে যে-সুগন্ধ বেরোচ্ছে, তাতে আমি কাঁচা মাংসের গন্ধ পাচ্ছি; তাতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে? আর আমি কী করে বলি যে গাড়িতে বসে ফেরিতে উঠতে আমার ভয় হচ্ছে? আমাদের সামনের পেছনের বাসগুলোর লোকদের তো ভয় হচ্ছে না। দেলোয়ার আর তার বউর তো ভয় হচ্ছে না। আমার একা কেনো ভয় হবে? আমার একার ভয় হওয়া ন্যায়সঙ্গত নয় বলে আমার মনে হচ্ছিলো। তবে আমার ভয় করছিলো; তাতেই হয়তো আমি বেশি করে তীব্র মাংসের গন্ধ পাচ্ছিলাম। গাড়িতে বসে পানি দেখলে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চায়; আমি দেখতে পাই বাক্সের ভেতরে বন্দী করে কারা যেনো আমাকে পানিতে ফেলে দিয়েছে; আমি বেরোতে পারছি না। আমার এই অনুভূতি হতে থাকে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে।
আমি হঠাৎ দরোজা খুলে বাইরে একটি পা রাখি।
তুমি বাইরে বেরোতে চাও? দেলোয়ার জিজ্ঞেস করে।
আমি কোনো উত্তর দিই না; তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
ডলি, তুমিও বেরোও, দেলোয়ার পেছনের দিকে তাকিয়ে বলে, ফেরিতে ওঠার সময় গাড়িতে থাকা ঠিক না।
আমি নিশ্চিত ছিলাম ডলি বেরোতে চাইবে না, দেলোয়ারের সাথেই থাকতে, চাইবে;–আমি তা-ই চাচ্ছিলাম। কিন্তু ডলি দরোজা খুলে বেরোনোর উদ্যোগ নিলে আমি অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করি; আমি বন্দী হয়ে পড়ছি বলে আমার মনে হয়। ডলির সাথে এখনো আমার সরাসরি কোনো কথাই হয় নি; সে গাড়ি থেকে বেরোলে আমার কি তার সাথে কথা বলতে হবে না? আমি কি তাকে পেছনে রেখে পোন্টুনের দিকে একা হাঁটতে পারবো? একা হেঁটে যাওয়া কি ঠিক হবে? তার সাথে আমি কী কথা বলবো? আমি এগিয়ে গিয়ে কথা বললে সে কি কিছু মনে করবে না? দেলোয়ার কি গাড়ি থেকে তাকিয়ে লক্ষ্য করবে না আমি ডলির সাথে কীভাবে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছি? তার কি তখন একটু কেমন লাগবে না? নিজেকে আমার অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে; একবার সামনের দিকে বেশ বড়ো করে পা ফেলি, ঠিক কোথায় পা ফেলবো বুঝে উঠতে পারি না; একটু থেমে যাই, এবং পেছনের দিকে তাকাই। ওদিকে সামনে গাড়ি চলতে শুরু করেছে, ফেরিতে ওঠা শুরু হয়ে গেছে, দেলোয়ার বেশ দ্রুত গাড়ি এগিয়ে নিচ্ছে। আমাদেরও–ডলির এবং আমার, তাড়াতাড়ি ফেরিতে গিয়ে উঠতে হবে। আমি একবার ডলির দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াই; ডলিও একবার আমার দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়।