ডলি বলে, আমার হাতটি একটু শক্ত করে ধরুন।
আমি শক্ত করে ধরার চেষ্টা করি, পারি না; মনে হয় অন্য একটি হাত আমার হাতটিকে সরিয়ে দিচ্ছে। আমার হাত ডলির হাত থেকে খসে পড়ছে।
ডলি বলে, ধরুন, আমার ভয় করছে।
আমি বলি, আমি ধরতে চাচ্ছি, কিন্তু পারছি না।
ডলি বলে, দেলোয়ারের লাশ কি সত্যিই ভেসে উঠতে পারে?
আমি বলি, কঙ্কাল কখনো ভাসে না।
ডলি বলে, আপনি দু-হাত দিয়ে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুন।
আমি ডলিকে জড়িয়ে ধরে একটা মাংসঅস্থিহীন সুগন্ধ পাই। আমি একটু শক্ত করেই ধরি; আমার ভয় হয় নইলে অন্য কোনো হাত আমাকে টেনে ডলির কাছ থেকে সরিয়ে দেবে। আমি মনে মনে সেই হাত দুটিকে ঠেলে সরিয়ে দিই; ডলি শিশুর মতো আমার বাহুর ভেতরে পড়ে থাকে-এখন ওর ভয় করছে না। এমন সময় বৃষ্টি নামে-শ্যামল শুভ্র নিবিড় বৃষ্টি; চারপাশ শাদা হয়ে যায়, বেবি এগিয়ে যেতে যেতে চারপাশ আরো শাদা থেকে আরো শাদা হতে থাকে; আরো অন্ধকার থেকে আরো অন্ধকার হতে থাকে। আমি বেবিঅলাকে আস্তে চালাতে বলি। দু-পাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটা ঢুকে আমাকে শীতল করে দিতে চায়, কিন্তু আমি বিস্ময়কর উষ্ণতা বোধ করি। বাঙলায় এমন আশ্চর্য বৃষ্টি নামতে পারে। দু-পাশের গ্রামগুলোকে ডলির ভুরুর মতো মনে হয়। ডলির মুখটি আমার দিকে এগিয়ে এসেছে, বৃষ্টির ফোঁটায় ডলির মুখ রজনীগন্ধার গুচ্ছ হয়ে উঠেছে; আমি রজনীগন্ধার গন্ধ পেতে থাকি। আমি ডলিকে আরো জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমো খাই। ডলির ঠোঁট আমার ঠোঁটে রজনীগন্ধার পাপড়ির মতো ঝরে পড়ে।
ডলি ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলে, আমি যাবো না।
আমি জানতে চাই, কোথায়?
ডলি বলে, ফেরিঘাটে। আমি ফেরিঘাটে যাবো না; আমি কারো কাছে অপরাধ করি নি।
ডলি বেবি থামাতে বলে; একবার বৃষ্টিতে ভিজে আসতে তার ইচ্ছে হয়; দূরে একটা ঝোঁপ দেখে আমি ভয় পাই। আমার ভয় হতে থাকে এই বৃষ্টিতে নামলে ধীরে ধীরে আমরা ঝোঁপের ভেতরে ঢুকে যাবো; ডলিকে নিয়ে আমি ঝোঁপের ভেতর ঢুকতে পারবো না। আমরা ফিরতে থাকি। ডলির শরীর থেকে সুগন্ধ বেরোচ্ছে; সুগন্ধটি কি ক্রমশ মাংসমেশানো হয়ে উঠছে? আমার দম আটকে আসছে না। আমি ডলিকে তাদের দরোজায় নামিয়ে দিয়েই ফিরতে চেয়েছিলাম; ডলি ফিরতে দেয় না; আমি ডলির গোড়ালির শুভ্রতা দেখতে দেখতে আর সুগন্ধ অনুসরণ করতে করতে তাদের বসার ঘরে ঢুকি। ঢুকে দেখি ডলির আম্মার সাথে দেলোয়ারের আম্মা বসে আছেন। তাকে দেখে আমার হাসি পায়।
দেলোয়ারের আম্মা আমাকে বলেন, তুমি জানো ডলি দেলোয়ারের বউ?
ডলি আর আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি; ডলির আম্মা উঠে ভেতরের দিকে চলে যান।
দেলোয়ারের আম্মা বলেন, তুমি ডলিকে নষ্ট করছো।
ডলি বলে, আপনি এমনভাবে কথা বলবেন না।
দেলোয়ারের আম্মা বলেন, তোমরা দুজন আমার দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দিয়েছো।
ডলি মেঝের ওপর বসে পড়ে, আমি দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
তিনি বলেন, দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দিয়ে তোমরা সুখে আছো। তোমরা সুখে থাকো, কিন্তু দেলোয়ারকে তোমরা কেনো নদীতে ফেলে দিলে?
আমি বেরিয়ে আসি। আমরাই দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দিয়েছি? আমি ফেলে দিয়েছি? ডলি ফেলে দিয়েছে? ডলি আর আমি ফেলে দিয়েছি? আমরা দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দিই নি? দেলোয়ার কীভাবে নদীতে পড়েছিলো, আমার ঠিক মনে পড়ে; আমার মনে হয় দেলোয়ার ফেরিতে উঠে গাড়ি থামিয়ে ডলি আর আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো, সিগারেট ধরিয়ে টান দিচ্ছিলো, তখন ডলি আর আমি ঠিক করি দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দেবো: আমরা দুজনে পেছন থেকে তার গাড়িটি ঠেলে পানিতে ফেলে দিই। দেলোয়ার কী করো, কী করো বলে হাসতে হাসতে পানিতে ডুবে যায়। আবার আমার মনে হয় আমি একটা ট্রাক চালাচ্ছিলাম, দেলোয়ার চালাচ্ছিলো তার দামি সুন্দর গাড়ি; দেলোয়ারের গাড়িটা আমার ট্রাকের আগে ছিলো; অতো সুন্দর গাড়িতে কেউ বসে থাকলে আমার সহ্য হয় না, আমি সহ্য করতে পারি নি; আমি আমার ট্রাক দিয়ে ঠেলে দেলোয়ারের গাড়িটাকে নদীতে ফেলে দিই। আমি যাকে ঠেলে নদীতে ফেলে দিয়েছি, তার নাম কী ছিলো?–মাহমুদ, আবদুল হালিম, দেলোয়ার? সে কি আমার বন্ধু ছিলো? বন্ধুকে আমি কী করে ট্রাক দিয়ে ঠেলে নদীতে ফেলে দিতে পারলাম? আমি কি আজ তার বউকে জড়িয়ে ধরেছি? আমি কি আজ তার বউকে চুমো খেয়েছি? আমি কি তার বউকে জড়িয়ে ধরে চুমো খাওয়ার জন্যে তাকে ঠেলে নদীতে ফেলে দিয়েছি? আমার বন্ধু কি তার বউকে কখনো বলেছে যে আমি নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম? বাবাকে চল্লিশ হাজার টাকা দিতে হবে? বাবার নিশ্চয়ই দরকার। চার সদস্য দলের একজন হিশেবে আমাকে রাখবে তো? আমার বেশ টাকা থাকবে? হজও হবে? হজ কাকে বলে? ট্যুরিজম? ধর্মীয় ট্যুরিজম বেড়াতে আমি ওখানে যাবো কেনো? টেকনাফ না গিয়ে? আমার অপরাধের শেষ নেই? আমি নিয়মিত অপরাধ করি? ভিখিরিনিটাকে আমি কেনো জিজ্ঞেস করেছিলাম তার বাচ্চার বাপ কে? বাপ কে তাতে কী আসে যায়? ডলিকে আমি নষ্ট করছি? নষ্ট কাকে বলে? দেলোয়ার ডলিকে পবিত্র করতো? ডলিকে আমি চুমো খেয়েছি-নষ্ট করেছি? ডলি কি আমাকে নষ্ট করেছে? আমি কি এখন বাসায় ফিরবো?
আমি আবদুস সালামের বাসার দিকে হাঁটতে থাকি। সালামকেই আজ মনে পড়ছে। কেনো সালামকে মনে পড়ছে। অনেকবার যাবে বলেও তো তার বাসায় আজো আমার যাওয়া হয় নি। সালাম কি এখন বাসায় আছে? না থাকলেই ভালো; অন্য কোথাও যাওয়া যাবে। সালাম কি আরার চাকুরি নিয়েছে? ও বছরে তিনটা চাকুরি বদলায় কেনো? সালামের বউ দরোজা খুলে আমাকে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, ঢুকতে বলেন না। হয়তো একটু বেশি বিস্মিত হয়ে গেছেন; আমি আগে কখনো আসি নি, বারবার আসবে বলেও।