আমি বলি, আমাকে ডাকলেই পারতেন।
তিনি বলেন, না, না; একটা কথা বলতে এলাম।
আমি বলি, আপনি কেমন আছেন?
তিনি বলেন, ভালোই তো; তবে তোমার সাথে একটা কথা আছে।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
তিনি বলেন, আমার বেশ কিছু টাকা দরকার।
টাকার কথা শুনে আমার ভেতরটা শুকিয়ে যায়; বেশ কেনো, কিছু টাকাও আমি জমাতে পারি নি। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না এমনভাবে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
তিনি বলেন, চল্লিশ হাজার টাকার মতো দরকার, খুবই দরকার।
আমি বলি, এতো টাকা তো আমার নেই।
তিনি বলেন, নেই, তুমি সত্যি বলছো?
আমি বলি, সত্যি বলাই তো আপনি আমাকে শিখিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, কিন্তু তুমি যে-চাকরি করো, তাতে তো টাকা থাকার কথা।
আমি বলি, আমার বেতন কতো তা তো আপনি জানেন।
তিনি বলেন, তোমার চাকরিতে বেতন দিয়ে তো কেউ চলে না।
আমি বলি, আপনি তো ছেলেবেলায় আমাকে সৎ হওয়ার কথা বলতেন।
বাবা খুব বিব্রত বোধ করেন, মাথা নিচু করে বসে থাকেন; তিনি উঠে যেতে চেষ্টা করেন, কিন্তু উঠতে পারেন না; তিনি বসে থাকতে চান, কিন্তু বসে থাকতে পারেন না।
ডলি আমার অফিসে
ডলি আমার অফিসে এসে উঠবে কখনো ভাবি নি; তাকে আমার কক্ষে ঢুকতে দেখে আমি কেঁপে উঠি, দাঁড়িয়ে পড়ি, তার দিকে এগিয়ে যাই; আরেকটুকু হলে তাকে ছুঁয়ে ফেলতাম। অনেক আগে যে-মেয়েটিকে দেখলে আমি কেঁপে উঠতাম, সে যদি আমার ছাত্রাবাসের কক্ষে কখনো এসে উঠতো, আমি এমনই কেঁপে উঠতাম। ক-দিন ধরে অদ্ভুত একটা ভার চেপে আছে আমার ওপর, ভারটা যে কী আমি তা বুঝতে পারছি না, কিন্তু ওই ভারের চাপে আমি মাথা তুলতে পারছি না; ডলি ঢোকার সাথে সাথে ভারটা কেটে যায়। ভারটা কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি কাটলো? দেলোয়ারের বাবার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমি ডলিদের বাসায় যাই নি, কিন্তু প্রতিমুহূর্তে গিয়েছি; আর কখনো যাবো না ভেবেছি, এবং আমার ওপর ভারটা ক্রমশ ভারী থেকে আরো ভারী হয়ে উঠেছে। সময় আমার জন্যে দীর্ঘ হয়ে উঠেছে; একেকটি মিনিট একেক ঘণ্টার থেকে দীর্ঘ হয়ে উঠেছে; আমি সময়ের একটা অবর্ণনীয় ভার বহন করেছি। একেকবার আমার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করেছে; আমি চিৎকার করেছি যে-চিৎকার আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় নি। গতকালই একটা শস্তা চায়ের দোকানে বসে আমি পাঁচ পেয়ালা চা খেয়েছি; একটি লোক আমরা সামনে বসে ইলশে মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছিলো, তার মুখ থেকে বারবার ভাত ছিটকে আমার হাতের ওপর পড়ছিলো; ভাত যে মানুষ এত যত্নের সাথে খায়, তা দেখতে দেখতে আমার ভারটা আরো বেড়ে যাচ্ছিলো। এখন নিজেকে আমার খুব হাল্কা লাগে। ডলিকে আমি কখনো নাম ধরে ডাকি নি; ডলিকে নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু আমি কোনো কথা বলতে পারছি না।
ডলি বলে, চলুন।
আমি তার কথা বুঝতে পারি না।
ডলি আবার বলে, আমার সাথে চলুন।
এবার আমি বুঝতে পারি; বলি, কোথায়?
ডলি বলে, আমি একটু ফেরিঘাটে যাবো।
আমি বলি, কোন ফেরিঘাটে?
ডলি বলে, আমার ও আপনার জন্যে একটিই ফেরিঘাট আছে।
আমি বলি, সেখানে যেতে আমার ভয় করবে।
ডলি বলে, ভয় করবে কেনো?
আমি বলি, ক-দিন ধরে আমি দেখতে পাচ্ছি ফেরিঘাটে দেলোয়ারের লাশ ভাসছে; দেলোয়ারের লাশ আমাকে ডাকছে।
ডলি বলে, আপনি অপরাধরোধ আর দুঃস্বপ্নে ভুগছেন।
ডলি উঠে দাঁড়ায়; এবং বলে, চলুন।
আমি ডলির সাথে উঠে দাঁড়াই; এবং বেরিয়ে পড়ি। ডলির পেছনে পেছনে হাঁটতে আমার ভালো লাগে; মনে পড়ে কোনো নারীর পেছনে এর আগে আমি হাঁটি নি; আমি মন দিয়ে ডলির পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকি। আমি ডলির ধবধবে গোড়ালি দেখতে পাই; লাল স্যান্ডলের ওপর ধবধবে গোড়ালি দেখে আমার সরোবরের কথা মনে পড়ে। আমরা একটি বেবি নিই, ডলিকে আমি উঠতে বলি, ডলি উঠে ডান দিকে বসে; আমি বাঁ দিকে বসি। বেবি চলতে শুরু করলে একবার আমার মনে হয় দেলোয়ার চালাচ্ছে; আমি ড্রাইভারকে ডাকি, তার মুখের সাথে দেলোয়ারের মুখের কোনো মিল নেই। তখন আমি বাইরের দিকে তাকাই। ডান দিকে তাকাতে সম্ভবত আমার সাহস হয় না।
ডলি জিজ্ঞেস করে, আপনি ড্রাইভারের মুখের দিকে এমনভাবে তাকালেন কেনো?
আমি বলি, মনে হচ্ছিলো দেলোয়ার চালাচ্ছে।
ডলি বলে, আপনি কি সব সময় চারপাশে দেলোয়ারকে দেখতে পান?
আমি বলি, আপনি পান না?
ডলি বলে, না।
আমি আজ মাংসমেশানো তীব্র সুগন্ধটি পাচ্ছি না; ডলির শরীর থেকে একটা মাংসসম্পর্কহীন সুগন্ধ বেরিয়ে আসছে। ডলি অনেক দিন মাংসের জগত থেকে দূরে আছে বলেই হয়তো তার মাংস থেকে আর ঝাঁজালো গন্ধ বেরোচ্ছে না। গন্ধটা আমার ভালো লাগছে, আমি বড়ো একটা নিশ্বাসে অনেকটা সুগন্ধ ভেতরে টেনে নিই; ডলি তা টের পায়, কোনো কথা বলে না। বেবি বেশ তীব্র গতিতে ছুটে চলছে, ডলি না থাকলে আমি মাঝেমাঝেই ভয় পেতাম; একটি ট্রাকের পাশ দিয়ে যেভাবে বেবিটি কেটে বেরিয়ে গেলো তাতে আমি প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠতাম; কিন্তু, মনে হয়, ডলি আমার পাশে বসে আছে বলেই আমি ভয় পেলাম না; ট্রাকের চাকাগুলোকে সুন্দর রঙিন : খেলনার মতো লাগলো। ডলি তার বাঁ হাতটি বাড়িয়ে আমার ডান হাতটি ধরেছে। আমি ভেবেছিলাম ভুল করে সে আমার হাত ধরেছে। আমি আমার হাতটি টেনে নিতে চাই, পারি না; আমার হাতটি ওই হাতের সাথে লেগে থাকে, ওই হাতে আটকে থাকে, আমি সরিয়ে আনতে পারি না।