আমি বলি, আমার নাম রাখবেন না, স্যার; সদস্য হতে আমার ভালো লাগবে না।
তিনি বলেন, তুমি বোধ হয় আরো বেশি চাও; ঠিক আছে, যাতে জন পঞ্চাশেক লোক তুমিও পাঠাতে পারো, তাও আমি দেখবো;–তোমার অন্তত পাঁচ লাখ থাকবে।
আমি বলি, স্যার, আমি সদস্য হতে চাই না, লোকও পাঠাতে চাই না।
তিনি বলেন, কেনো?
আমি বলি, আমি নোটটি লিখতে পারবো কি না জানি না; তারপর নোট লিখলেও মরুভূমিতে আমি যেতে পারবো না।
তিনি বলেন, কেনো?
আমি কোনো জবাব দিই না।
তিনি বলেন, ওমরাটাও তোমার করা হয়ে যাবে, বেশ কিছু ডলারও থাকবে।
আমি বলি, হজ করতে আমার ভালো লাগবে না।
সচিব লাফিয়ে ওঠেন, চিৎকার করেন, তুমি কি মুসলমান নও?
আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না; এ-প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর আমার জানা নেই বলে মনে হয়। আমি বুঝতে পারি আমার সাথে তার আর কোনো কথা নেই। ফিরে এসে আমি নোটটা লিখে ফেলি, লিখতে আমার খারাপ লাগে না; লেখার পর দেখতে পাই বেশ গুছিয়ে লিখেছি; আমি কয়েকবার পড়ি নোটটা, পড়তে পড়তে আমার মুখস্থ হয়ে যায়।
ছুটির দিন; ঘুম থেকে জেগে দেখি সিগারেট নেই। চায়ের সাথে সিগারেট না খেলে আমার মনেই হয় না চা খাচ্ছি; মনেই হয় না ভোর হয়েছে; মনেই হয় না বেঁচে আছি; মনেই হয় না আমার বেঁচে থাকা দরকার। সিগারেট না থাকলে আমি কাজের মেয়েটিকে ডাকি, আজো ডাকছি; মেয়েটি আমার ডাকে ভোরের আলোর মতো ছুটে আসে, আজ আসছে না। মেয়েটির একটা রোগ আছে, মাঝেমাঝে পেটের ব্যথায় কাতরাতে থাকে–দেখলে মনে হয় মেয়েটি খুব কষ্ট পাচ্ছে; আমি একদিন পেট টিপেও দিয়েছিলাম; মেয়েটি আমার হাত তার পেটে শক্ত করে চেপে ধরেছিলো; আজ হয়তো তাই হয়েছে। আগেই বোঝা উচিত ছিলো মেয়েটির কিছু হয়েছে; চা চাওয়ার পর মেয়েটি চা আনে নি, মা-ই চা নিয়ে এসেছে; তখনই আমার বোঝা উচিত ছিলো। ওই হিতৈষী লোকটির পরামর্শ শোনা উচিত হয় নি আমার; লোকটি সিগারেট ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলো, ছেড়ে দেয়ার পর তার কী কী উন্নতি হয়েছে তাও বুঝিয়ে বলেছিলো; আর ছেড়ে দেয়ার একটা উপায়ও দেখিয়ে দিয়েছিলো। ছেড়ে দেয়ার উপায় হচ্ছে পাঁচটি পাঁচটি করে সিগারেট কেনা; পুরো প্যাকেট না কেনা। আমার অভ্যাস একসাথে দশ প্যাকেট কেনা; সেখান থেকে পাঁচটায় এসেই বিপদে পড়েছি, আধঘণ্টা পরপরই সিগারেট শেষ হয়ে যায়, আর মেয়েটিকে আমি দিনে পাঁচসাতবার ডাকাডাকি করি। প্যাকেটে পাঁচটা সিগারেট দেখলেই আমার ভয় লাগে, মনে হয় পৃথিবীতে সিগারেট নেই; আমার সিগারেট খাওয়ার তৃষ্ণাটা তখন তীব্র হয়ে ওঠে, পৃথিবীর সব সিগারেট একসাথে টানতে ইচ্ছে করে, আনার সাথে সাথেই আমি সিগারেটগুলো শেষ করে ফেলি; আবার মেয়েটিকে ডাকতে থাকি। মেয়েটিও চমৎকার, টাকা নিয়ে নাচতে নাচতে সিগারেট আনতে চলে যায়। আমার সিগারেট দরকার; তাই কি ও এমন নাচতে নাচতে যায়? না কি মুদিদোকানটিতে যেতে পারছে বলেই ওর পায়ে নাচ আসে? কে ওকে নাচায়? নাচুক ও; কিন্তু আজ আসছে না।
মা এসে জানতে চায়, মেয়েটিকে ডাকছো কেনো?
আমি বলি, সিগারেট আনতে হবে।
মা বলে, ওর পেট ব্যথা করছে।
সিগারেট ছাড়াই আমাকে নিরর্থক বেঁচে থাকতে হবে; আমি নিজে এখন সিগারেট কিনতে যেতে পারবো না; অর্থাৎ আমাকে বেঁচে থাকতে হবে কিন্তু আমি বেঁচে থাকবো না। আমি উঠে বাথরুমে যাই; সেখান থেকে বাবা ও মা কথা বলছেন শুনতে পাই, শুনে আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
বাবা বলছেন, আনিস মেয়েটিকে ডাকছে কেনো?
মা বলছে, সিগারেট আনার জন্যে।
বাবা বলছেন, আমাকে টাকাটা এনে দাও না, আমি সিগারেট এনে দিই।
বাবার কথা শুনে আমার সব কিছু ঠাণ্ডা হয়ে যায়, কাঁপতে থাকে; আমি আর বাথরুম থেকে বেরোতে পারবো না। অবসর নেয়ার পর থেকেই বাবা কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছেন, শিশু হয়ে যাচ্ছেন; সবাইকে ভয় পাচ্ছেন। আগে সবাই তার ভয়ে কাঁপতাম, মনে মনে এখনো আমি কাঁপি; কিন্তু আজকাল তিনিই সবার ভয়ে কাঁপছেন। তাঁকে আগে কখনো নামাজ পড়তে দেখি নি, আজকাল মসজিদেও যাচ্ছেন; এবং দাড়ি রেখেছেন, মুখ বেশ ঢেকে গেছে কয়েক মাসে। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম দাড়ির কোনো উপকার পাচ্ছেন কি না; জবাব দিয়েছিলেন যে বেশ পাচ্ছেন, লোকজন নিয়মিত সালাম দিচ্ছে, আগে এতো সালাম পেতেন না; আর সালাম পেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আমি বলেছিলাম, আমিও দাড়িটা রেখে ফেলবো ভাবছি, ধার্মিক হতে হলে সময় থাকেতই হওয়া ভালো, বুড়ো বয়সে ধার্মিক হওয়া খুব সন্দেহজনক; শুনে তিনি হাহাকার করে উঠেছিলেন; মার কাছে কয়েক দিন বারবার জানতে চেয়েছিলেন সত্যিই আমি দাড়ি রাখতে যাচ্ছি কি না, ধার্মিক হতে যাচ্ছি কি না; মাকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে আমি দাড়ি না রাখি। আমি প্রথম যখন সিগারেট ধরেছিলাম তিনি জানতে পারেন নি, জানার পর বেশ বড়ো একটা শাস্তি দিয়েছিলেন; দু-দিন একটি ঘরে আটকে রেখেছিলেন। আমি আজো সিগারেটে প্রতিটি টানের সাথে দু-দিন করে একটি ঘরে আটকে থাকি।
বাথরুম থেকে বেরোনোর পর মা বলে, টাকা দাও, সিগারেট আনিয়ে দিই।
আমি বলি, না, লাগবে না।
দুপুরে বাবা আমার ঘরে আসেন, আমি অবাক হই; আমার ঘরে তিনি অনেক বছর আসেন না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় খুবই ভয়ে আছেন, সাহস করে এ-ঘরে ঢুকেছেন; বিনা অনুমতিতে ঢোকার জন্যে তিনি ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছেন না। তাই তাড়াতাড়ি আমার বিছানার ওপর বসে পড়েন। চেয়ারও ছিলো দুটি; কিন্তু চেয়ারে তিনি বসলেন না, এটাই প্রথম আমার চোখে পড়লো;–আমি বাবার দিকে না তাকিয়ে চেয়ার দুটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।