হাবশি হওয়ার জন্যে, আমি জানি, সবাই পাগল। পুকুরে পুকুরে কেউ পুঁটিমাছ ধরতে চায় না, পুকুরই নেই-পুঁটিমাছ কোথায়; সবাই হাবশি হতে চায়। নতুন একটা হাবশি জাতি হয়ে উঠছি আমরা–চমৎকার। তবু ওরা, এই আট হাজার, ঝাড়ুদার হবে; কিছু দিন পর হয়তো আমাকে পঞ্চাশ হাজার খোঁজা পাঠানোর নোট লিখতে হবে। আমাদের খোঁজারাই শ্রেষ্ঠ, ওদের সব কিছু উপড়ে ফেলা হয়; তারপর শেলাই করে দেয়া হয়; আপনারা আমাদের দেশ থেকে খোঁজা নিন, এমন কোনো আবেদন লিখতে হবে হয়তো আমাকেই আট হাজার হাবশি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দেয়াই তো ভালো; যেতে না পারলে ওরা ডাকাতি করবে, যারা চমৎকার আছি তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। ওদের হাবশি করে তোলাই ভালো। হাবশি হলেও বেশ বেতন পাবে,-আমার তিনগুণ; ফিরে ভালো বিয়ে করতে পারবে, অষ্টম শ্রেণী ফেলকরা ছেলেগুলো দেশে ফিরে বিএ পাশ মেয়ে বিয়ে করতে পারবে। সমাজের উন্নতি হবে, শিক্ষিত মায়েদের পেট থেকে শিক্ষিত সন্তান বেরোবে; সন্তানগুলোর গায়ে লেখা থাকবে না বাপ অষ্টম শ্রেণীতে ফেল করেছিলো; লেখা থাকবে না ওরা মেথরের সন্তান। ওরা হাবশি হোক, মেথর হোক আমার কিছু যায় আসে না; কিন্তু আমার কাছ থেকে যে-নোট চাওয়া হচ্ছে তা আমার লিখতে ইচ্ছে করছে না। ওখান থেকে যে-প্রস্তাব এসেছে, তা আমার খুব খারাপ লাগছে না; বিমান ভাড়া দিয়ে ওরা নেবে, তিন বছর পর ফেরার সময় বিমান ভাড়া দেবে, আর যে-বেতন দেবে সব ব্যয়ের পরও তিরিশ হাজারের মতো থাকবে। খুব খারাপ মনে হচ্ছে না আমারা কাগজপত্র দেখেই চুক্তিটা করে ফেলতে পারি; বা বেতন বাড়ানোর জন্যে একটা দাবি পাঠাতে পারি।
আমার কাছে চাওয়া হচ্ছে অন্য ধরনের নোট; লিখতে হবে ব্যাপারটি দেখার জন্যে কমপক্ষে চার সদস্যের একটি উচ্চপর্যবেক্ষক দল ওখানে যাওয়া দরকার; কেননা বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আট হাজার লোকের ব্যাপার; তাই সব কিছু ভালোভাবে দেখেই চুক্তি করা উচিত; নইলে মন্ত্রণালয় আর রাষ্ট্র অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। এটা লেখার কোনো ইচ্ছে আমার হচ্ছে না। মন্ত্রণালয় আর রাষ্ট্র অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়বে? অস্বস্তি কাকে বলে? রাষ্ট্র আর মন্ত্রণালয় অস্বস্তিকে কবে পাত্তা দিয়েছে। আমার হাসি পায়; আমি আমলা, আমার কাজ নিজের প্রয়োজনে দুঃস্বপ্ন বানানো; দুঃস্বপ্নটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা। আমি তা পারছি না। কিন্তু আজই ফাইলটা যুগ্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, এগারোটার মধ্যে না পৌঁছোলে সচিব আমাকে ডাকবেন–এমন একটা আভাস সকালেই পেয়েছি। আমি নোট লিখছি না; বরং আমার ভিখিরিনিটিকে মনে পড়ছে; লিকলিকে কুৎসিত মেয়েটিকে মনে পড়ছে। লিকলিকে কুৎসিত মেয়েটি পিঠে প্রায়-মরা একটা বাচ্চা নিয়ে আমার সামনে হাত পেতেছিলো; মনে হয় এখনো হাত পেতে আছে। আমি চারদিকটা আরেকবার দেখে নিই। না, এখানে কোনো আবর্জনা নেই; কোনো নোংরা হাত নেই। মেয়েটিকে দেখেই আমার ঘেন্না লেগেছিলো, তারচেয়ে বেশি ঘেন্না লেগেছিলো পিঠের প্রায়-মরা বাচ্চাটিকে দেখে। অমন বাচ্চা আমি দেখতে পারি না; বাচ্চাঅলা ভিখিরিনিদের আমি কখনো ভিক্ষা দিই না, বুড়ো ভিখিরিগুলোকেও দিই না; আমার ঘেন্না লাগে।
ভিখিরিনিটি হাত পেতে বাচ্চাটার জন্যে একটা টাকা চায়। আমি এড়িয়ে যেতে পারতাম; এড়াই না, দাঁড়াই; জিজ্ঞেস করি, বাচ্চাটা কার?
ভিখিরিনিটি বলে, আমার।
আমি বলি, ওর বাপ কোথায়?
ভিখিরিনিটি বলে, মইর্রা গ্যাছে।
আমি বলি, সত্য করে বলল ওর বাপ কে?
মেয়েটি ভয় পেয়ে যায়; বলে, ছার, রাস্তায় হুই, বচ্ছর বচ্ছর বাচ্চা হয়; বাপের খবর রাকতে পারি না।
সচিব আমাকে সালাম দিয়েছেন;–সালাম শব্দটি শুনলে আমার হাসি পায়। প্রথম যোগ দেয়ার পর পিয়ন আমাকে এসে বলেছিলো, ছার আপনেরে ছালাম দিছে। আমি ব্যাপারটি বুঝি নি, বলেছিলাম, স্যারকে গিয়ে বলো অলাইকুম সালাম। পিয়ন হেসে বলেছিলো, এইডা না, ছার আপনেরে ডাকছেন। আজো আমার হেসে উঠতে ইচ্ছে করে, আমি হেসে উঠি।
সচিব আমাকে বলেন, তুমি ফাইলটা ছাড়ছো না কেনো?
আমি একটু সময় নিই, কী বলবো বুঝতে পারি না; তারপর বলি, স্যার, আমাকে আপনি বলেই সম্বোধন করবেন।
সচিব চমকে ওঠেন; এটা তিনি আশা করেন নি। তিনি বলেন, তুমি বেয়াদবি করছো, খুব বিপদে পড়বে।
আমি বলি, আমাকে ক্ষমা করবেন, স্যার; আপনাকে অপমান করার জন্যে কথাটি বলি নি, বিপদেও আমি পড়তে চাই না; তবে অপরিচিত কেউ আমাকে তুমি বললে আমার ভালো লাগে না।
তিনি আরো ক্ষেপে উঠে চিৎকার করে বলেন, আমি তোমার অপরিচিত নই।
আমি বলি, আপনাকে আমি চিনি, আপনার সব সংবাদ জানি, আপনার বাল্যকাল থেকে গতকালের সব গল্প আমার জানা; আপনার তৃতীয় স্ত্রীকেও আমি দেখেছি; তবু আপনাকে আমার অপরিচিত মনে হয়।
তিনি বলেন, তুমি দাঁড়াও, দাঁড়িয়ে কথা বলো; আমার সামনে তোমার বসার অধিকার নেই।
আমি দাঁড়াই, দাঁড়াতে আমার খারাপ লাগে না; বসেই আমার খারাপ লাগছিলো, দাঁড়িয়ে আমার ভালো লাগে; সারাদিন আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো।
তিনি বলেন, নোটটা আজই লিখে দাও।
আমি বলি, স্যার, আমি লিখতে পারছি না।
তিনি বলেন, তোমাকে কথা দিচ্ছি চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য হিশেবে তোমার নাম আমি রাখবো।