আমার কথা শুনে ডলি চমকে ওঠে; তারপর ডলিকে অসহায় দেখায়; তারপর ডলিকে রক্তশূন্য দেখায়; তারপর ডলিকে সুন্দর দেখায়; তারপর ডলিকে অপরাধী দেখায়। নিজেকে আমার হাল্কা লাগে; ডলিকে এমন অসহায় রক্তশূন্য সুন্দর অপরাধী দেখায় যে আমার ভেতরের অপরাধবোধটা অনেকটা কেটে যায়, আমি নাভিটির দিকে তাকিয়ে থাকি। তাহলে আমার থেকে ডলি বেশি অপরাধ করেছে; আমার অপরাধ ডলির অপরাধের থেকে কম। কিন্তু ফেরিঘাটে আমি কেনো গিয়েছিলাম? আমার কোনো কাজ ছিলো না বলে? আমার সময় কাটছিলো না বলে? নদীর দৃশ্য দেখতে ইচ্ছে করছিলো বলে? আমি ভুল করে একটা বাসে চেপে বসেছিলাম বলে? আমার মনে পড়ছে আমি একটা বাসে চেপে বসেছিলাম; বাসে আমি অনেক ধরনের গন্ধ। পেয়েছি, কিন্তু কোনো মাংসমেশানো তীব্র সুগন্ধ পাই নি। মাংসমেশানো তীব্র সুগন্ধ পাই নি বলে আমার দম আটকে আসে নি, বাস থেকে আমার নামতে ইচ্ছে করে নি; বাসটি যখন ফেরিতে উঠছিলো, তখনো আমি নামি নি; নামার কথাই আমার মনে আসে নি। একটা ভয়ঙ্কর শব্দ করে বাসটি ফেরিতে উঠেছিলো, উঠতে গিয়ে একবার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো; তাতে আমার অদ্ভুত ভালো লেগেছিলো; বাসের কেউ ভয় পায় নি-একটি লোক চিনেবাদাম খাচ্ছিলো; কেউ বাস থেকে নামে নি, আমিও নামি নি। বাসটির ইঞ্জিন আবার চালু হলে গোঁ গোঁ করে বাসটি ফেরির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়; আমি আমার সামনে পানি দেখে হেসে উঠি। পেছনে একটা ট্রাক এসে থামে, এতো মসৃণভাবে থামে যে মনে হয় কেউ শেলাইকল বন্ধ করলো। আমি বাস থেকে নামি নি, নামতে আমার ইচ্ছে হয় নি। ফেরি ছেড়ে দিলে আমার আরো বেশি ভালো লাগে; নদীটিকে আমার অচেনা মনে হয়। এই নদী আমি আগে দেখি নি? ফেরিটি নদীর অন্য পারে ভিড়তেই আমি বাস থেকে নেমে আসি; আমার মনে পড়ে আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই। ফেরিতে নেমে আমি ঝাল মুড়ি কিনি, খেতে আমার ভালো লাগে; অনেক দিন আমি ঝাল মুড়ি খাই নি, খাওয়ার কথাও মনে হয় নি। আমি কেনো এখানে এলাম একবার ভাবতে চেষ্টা করি। কার যেনো মুখ আমি মনে করার চেষ্টা করি, পরে মনে হয় দেলোয়ারের মুখ মনে করার চেষ্টা করছি; কিন্তু মনে করতে পারি না। এই নদীর তলদেশে যদি কখনো আমি ঘুমিয়ে পড়ি, আমার খারাপ লাগবে না; আমার হয়তো বেশি করে ঘুম পাবে; যে-ঘুম আমি ঘুমোতে চেয়েছি, কিন্তু পারি নি, সে ঘুম আমি ঘুমোতে পারবো। আমার ওপর দিয়ে ঘুমের স্রোত বয়ে যাবে। ফেরিটি আবার এপারে ফিরে আসে; আমি বাস থেকে নেমে একটি বেবি নিই; পোন্টুন বা নদীর পারে আমার দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না।
ডলি বলে, আমাকে নিয়ে গেলেন না কেনো?
আমি বলি, আপনার কথা আমার মনে পড়ে নি।
ডলি বলে, ফেরিঘাটে গেলেন অথচ আমার কথা মনে পড়লো না?
আমি বলি, আপনার কথা আমি সব সময় ভাবি না।
ডলি বলে, অথচ আপনার কথা আমি সব সময় ভাবি, দেলোয়ারের থেকে বেশি ভাবি; ফেরিঘাটের কথা মনে হলেই প্রথম আপনার কথা মনে পড়ে, তারপর দেলোয়ারের কথা।
আমি বলি, কেনো?
ডলি বলে, আপনার জন্যেই আমি আজ বেঁচে আছি। আপনার জন্যেই আমি অপরাধবোধের মধ্যে আছি।
আমি বলি, আমি আপনার বেঁচে থাকা আর অপরাধবোধ?
ডলি বলে, দুটোই।
এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে; ডলি গিয়ে দরোজা খুলে দেয়। ডলির সাথে ঢোকেন দেলোয়ারের আব্বা; আমি উঠে সালাম দিই।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি এ-বাসায় মাঝেমাঝেই আসো?
আমি বলি, জি।
তিনি বলেন, কিন্তু তুমি তো আমাদের বাসায় একবারও গেলে না।
আমি বলি, না।
তিনি বলেন, তোমাদের আগে থেকেই পরিচয় ছিলো?
আমি বলি, হ্যাঁ।
তিনি বলেন, দেলোয়ার না থাকায় তোমরা সুখীই হয়েছো।
আমি কোনো কথা বলি না, ডলি কোনো কথা বলে না। দেলোয়ারের আব্বা উঠে দাঁড়ান, দরোজার দিকে হাঁটতে থাকেন; দরোজা খুলে বেরিয়ে যান। ডলি কোনো কথা বলে না, আমি কোনো কথা বলি না।
আমার আলমারির ড্রয়ারে একটি ফাইল পড়ে আছে; অত্যন্ত জরুরি–সচিব আর যুগ্মসচিব চাচ্ছেন, মাননীয় মন্ত্রী এখনো চান নি; যুগ্মসচিব আভাস দিয়েছেন তিনিই আসলে এটা চান; আমি ড্রয়ারে ফেলে রেখেছি, ফাইলটির কথা মনে না পড়লেই আমি ভালো থাকি। কিন্তু কেনো ভালো থাকি? আমি বুঝতে পারি না। বিপ্লবটিপ্লব করে ফেলছি, তা নয়; একটা নৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছি, তাও নয়; তবে ওটির কথা মনে হ’লে আমার ভালো লাগে না। আমার কাছে একটি বিশেষ নোট চাওয়া হচ্ছে, আমার তা লিখতে ইচ্ছে করছে না; প্রত্যেক দিনই চাপ পড়ছে, আমাকে ওই নোট লিখতে হবে। আমি আমলা; আমি শিখেছি বস কখনো ভুল করতে পারেন না; আমার টেবিলেই, ইংরেজিতে, একটি শ্লোক বাঁধানো রয়েছে বস কখনো ভুল করতে পারেন না; যদি সন্দেহ হয় তুমি অপর পিঠ দেখো; অপর পিঠে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা আছে। বস কখনো ভুল করতে পারেন না। এ-শ্লোকের পবিত্রতায় আমার কোনো সন্দেহ নেই; এ-শ্লোক আমি মানি, প্রথম কলমার মতো এটি আমি মেনে চলবো সারাজীবন; কিন্তু আমি ওই নোট আমি লিখতে পারছি না। আমলা হওয়া আমার ঠিক হয় নি? আমার উচিত ছিলো রাড়িখাল ভাগ্যকূল কাজিরপাগলা কণকসার হাই ইস্কুলে মাস্টার হওয়া। আমি নোট লিখছি না এটা কোনো মহৎ কাজ নয়; কিন্তু আমি লিখতে পারছি না। সৌদিতে আট হাজার শ্রমিক পাঠানোর ফাইলে আমাকে এক পারা নোট লিখতে হবে; আমি না লিখলেও চলবে, শুধু আমাকে একটা সই দিতে হবে। এটা এমন কী কঠিন কাজ। মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় একটা প্যারা লিখে ফেলি, কী লিখবো তার ভাষাটাও আমার ভেতরে তৈরি হয়ে গেছে; কিন্তু লিখতে পারছি না। ওই ফাইলের কথা মনে হ’লে আমি মরুভূমি দেখতে পাই, মরুভূমিতে নিজেকে ঝাড়ুদার হিশেবে দেখতে পাই; আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মরুভূমি আমার ভালো লাগে না। এর চেয়ে আমি পুকুরে পুকুরে পুঁটিমাছ ধরে বেচবো। আধুনিক দাসব্যবসার ফাইল এটা; এ-দাসব্যবসার ফাইল আমার খুলতে ইচ্ছে করে না, সই দিতে ইচ্ছে করে না। সবুজ গাছপালা আর কালো মেঘের ছেলেগুলোকে, আমার মনে হয়, আমি দাস করে পাঠানোর নোট লিখছি। মনে হয় নিজেকেই দাস করে পাঠাচ্ছি; নতুন হাবশি হয়ে উঠছি।