আমি বলি, এই, দাঁড়া।
দারোয়ানটি লাফিয়ে উঠে সালাম দেয়। আমার বেশ ভালো লাগে।
সে বলে, কী, ছার?
আমি বলি, যা দেখে আয় আমার ঘরে তালা লাগানো হয়েছে কি না।
লোকটি দৌড়ে ওপরে উঠে যায়। আমি বুঝতে পারি না এখন কোথায় যাবো। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার ওপরে উঠতে থাকি; দেখি দারোয়ানটি নিচে নেমে আসছে; আমাকে দেখেই একটা সালাম দেয়, আর কী যেনো বলে; আমি তার কথা শুনতে পাই না, শুনতে চাই না; আমি আমার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকি; আর দারোয়ানটি আমার পিছে পিছে আসতে থাকে। আমি উঠে আমার ঘর খুলে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিই; দারোয়ানটি আমার দরোজায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। আমি চাই সে আমাকে ডাকুক, ভেতরে ঢুকুক; কিন্তু সে হয়তো সাহস পায় না; আমিও তাকে ডাকি না। কেরামতুল্লাহ মিয়া বারান্দায় বেরিয়েছেন, তাঁর জুতোর শব্দেই আমি তা বুঝতে পারি; দারোয়ানটিকে দেখে তিনি বলেন, এই হারামজাদা, তুই অইখানে কী করছ? এই দিকে আয়। দারোয়ানটি তাকে জোরে একটা সালাম দেয়, আমি ঘরে বসে শুনতে পাই। কেরামতুল্লাহ মিয়া বেশ জোরে কথা বলেন, এটা একটি সুবিধা; তিনি কোথায় আছেন, কী করছেন তা দূর থেকেও টের পাওয়া যায়। তিনি বলছেন, আমার ঘরে আয়, পাও দুইটা টিপ্পা দে। তারা দুজনে ঘরে ঢুকছে আমি বুঝতে পারি। এখন দারোয়ানটি কেরামতুল্লাহ মিয়ার ঘরে আছে, আমি বেরোলে তার সাথে দেখা হবে না; দাঁড়িয়ে সে আমাকে সালাম দেবে না; আমার একটু স্বস্তি লাগে। আমি বসে থাকতে পারি না, উঠে দাঁড়াই; দাঁড়াতে গিয়ে একবার পা কাঁপে; কিন্তু আমাকে এখনই বেরোতে হবে, দারোয়ানটির মুখোমুখি আমি দাঁড়াতে পারবো না, আমি আস্তে আমার ঘরের দরোজা খুলি, মাথা নিচু করে তালা লাগানোর চেষ্টা করি, তালাটি প্রথমে লাগতে চায় না, আমি একটু ঘেমে উঠি;–তারপর সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করি।
ডলি কয়েকবার ফোন করেছে, পায় নি; সে তার পরিচয়ও দেয় নি, দিতে তার ভালো লাগে নি; সে কোনো মেস্যাজ রাখে নি; মনে করেছে একবার না একবার পাবেই; এবার পেয়ে গেলো। ডলি আশা করেছিলো আমি তাকে টেলিফোন করবো, করি নি; করি নি বলে আমার স্বভাব সম্পর্কে-আমার সম্পর্কে-একটি সিদ্ধান্ত সে। নিয়েছে, যদিও সিদ্ধান্তটি আমাকে জানাবে না। আমি কি ডলির সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছি? কারো সম্পর্কে কোনো স্থির ধারণায় পৌঁছোনো আমার পক্ষে সম্ভব হয় না; কাউকে বছরের পর বছর ধরে দেখেও আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না যে সে এ-রকম, বা ও-রকম, বা সে-রকম; ডলির সম্পর্কে হয়তো কখনোই নিতে পারবো না। নেয়ার কথাই আমার মনে আসে নি। ডলি কি তার সাথে আমাকে সম্পর্কিত মনে করছে? সে কি মনে করছে আমরা দুজন একই অপরাধের শেকলে বাঁধা পড়ে গেছি, এবং আমাদের পরস্পর সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার? নইলে আমাকে সে খুঁজবে কেনো; সারাজীবনে সে খোঁজার দরকার বোধ করে নি; তার জীবনে আমি ছিলামই না; এই সেদিন প্রবেশ করেছি। ওই ঘটনা না ঘটলে সে আমাকে খুঁজতো না; ঘটনাটি ডলিকে-আমাকে বেঁধে ফেলেছে? একসঙ্গে? ডলি আমাকে খুঁজবে, একবার না পেলে বারবার খুঁজবে? আমি ডলিকে খুঁজবো, একবার না পেলে একশোবার খুঁজবো? ডলি আমাকে বাসায় যেতে বলছে; আজই যেতে বলছে-বিকেলেই; আমার সাথে তার অনেক কথা আছে। তার কথা আর কণ্ঠস্বর অদ্ভুত লাগছে আমার; এ-পর্যন্ত কেউ আমাকে বলে নি তার সাথে আমার অনেক কথা আছে। অনেক কথা কাকে বলে? আমি কখনো কারো সাথে অনেক কথা বলি নি, কখনো মনে হয় নি আমার কারো সাথে অনেক কথা আছে। অনেক কথা কি একা ডলিই বলবে, কি আমাকেও বলতে হবে? অনেক কথা শোনার জন্যে, অনেক কথা বলার জন্যে আমি তো কোনো ব্যাকুলতা বোধ করছি না।
আমি বলি, আমার সাথে আপনার অনেক কথা আছে?
ডলি বলে, তাহলে কার সাথে?
আমি বলি, কথাগুলো আপনি ভেবে ঠিক করে রেখেছেন?
ডলি বলে, চমৎকার লোক তো আপনি! কথা কি সব আগে থেকে কেউ ঠিক করে মুখস্থ করে রাখে? কথা বলতে বলতেই তো কথা আসে।
আমি বলি, কথা বলতে বলতে কি ঠিক কথা আসে?
ডলি বলে, ঠিক কথা বলে কিছু নেই; একই কথা ঠিক হতে পারে আবার ঠিক নাও হতে পারে।
আমি বলি, আপনার সাথে তো আমার অনেক কথা নেই।
ওপাশে ডলি নিশ্ৰুপ হয়ে যায়, যেনো সারা শহর ভ’রে মৃত্যু নেমে এসেছে; টেলিফোন জুড়ে বয়ে চলে ঠাণ্ডা নিস্তব্ধতা; তাতে আমার হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
মেরুশীতলতা থেকে মাথা জাগিয়ে ডলি বলে, আমার আছে।
আজই যাবো বলে ডলিকে আমি কথা দিই; তবে যতোই বিকেল হতে থাকে আমার ততোই ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সন্ধ্যায় আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না, বাইরে বেরোই। অনেক বছর পুরোনো বইয়ের দোকানে যাই না, পুরোনো নিউজপ্রিন্টের গন্ধ কি না; পুরোনো গন্ধের জন্যে আমার ভেতরটা ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। পুরোনো গন্ধ শুকতে শুকতে আমি সেদিকে এগোতে থাকি। পুরোনো বাঙলা বইয়ের গন্ধ আমার ভালো লাগে না, আমার পছন্দ ঝকঝকে নতুন বাঙলা বই; কিন্তু পুরোনো ইংরেজি বই, নিউজপ্রিন্টের, আমার ভালো লাগে; তার ভেতর থেকে একটা ধূসর গন্ধ ওঠে, বিদেশি গন্ধ ওঠে, আমার ভালো লাগে। রিক্সা থেকে নেমে আমি বই পর্যন্ত পৌঁছোতে পারি না; রেলিংয়ে বোম্বের একঝাক মেয়ের সারিসারি রঙিন ছবি আমাকে এলামেলো করে দেয়; আমার রক্ত থেকে নিউজপ্রিন্টের গন্ধ মুছে যায়, আমি রঙ আর রক্তের বিপর্যয়কর গন্ধ পেতে থাকি। আমার মগজে অজস্র রঙ হল্লা করে ঢুকতে থাকে, একটি মেয়ের নাভি দেখে আমি ওই অতল গহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই;–আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। একটু দূরেই রবীন্দ্রনাথ ঝুলছে, দেখে আমার হাসি পায়;–মহৎ হওয়ার কী কষ্ট; আমি এভাবে কখনো ঝুলবো না। নাভির মেয়েটির পাশে ওই ছবিটিকে অশ্লীল মনে হয়; আমি ওদিকে আর তাকাতে পারি না; কিন্তু নাভি আমাকে টানতে থাকে। নাভি, নাভি, নাভি। রবীন্দ্রনাথ যদি এখন এসে দাঁড়াতো কোন ছবিটি তাকে টানতো? কোন ছবিটি সে কিনতো? কোনো ছবি সে কিনতো না, সে মহাপুরুষ; আমি মহাপুরুষ নই, কখনো হবো না; পুরোনো বইয়ের দোকানে আমি এসেছি, কিন্তু বইয়ের কাছে যেতে পারছি না, আমাকে টেনে ধরে আছে ওই পাতালগভীর নাভিটি। কোনটি আমি কিনবো–নাভি না রবীন্দ্রনাথ? নাভি কেনা আমার ঠিক হবে না, কিনলে রবীন্দ্রনাথই কেনা উচিত। কিন্তু নাভিই আমাকে টানছে, নাভিই ডাকছে আমাকে। আমি নাভিটি কিনে ফেলি; লোকটি সুন্দরভাবে গুটিয়ে নাভিটি আমার হাতে তুলে দেয়।