কয়েক দিন আগে এটা আমার চোখে পড়ে; পড়ার পর থেকেই আমি ভয় পাচ্ছি–ঠাণ্ডা একটা ভয়; ভয়টা শিরশির করে আমার রক্তের ভেতর দিয়ে বয় আমি তা টের পাই। সকালে আমি যতোই অফিসের দিকে এগোতে থাকি, ভয়টা বাড়তে থাকে; আমার ভয় করতে থাকে যে আজো যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠবো দারোয়ানটি আমাকে দেখে দাঁড়াবে না, সালাম দেবে না। আগে কি দারোয়ানটি আমাকে সালাম দিতো না? আমাকে দেখে পঁড়াতো না? যতো দূর মনে পড়ছে লোকটি আগে আমাকে দেখেই লাফিয়ে উঠতো, একটা বড়ো সালাম দিতে; আমার হাতের জিনিশপত্রগুলো নেয়ার জন্যে অনেকটা টানাটানিই করতো। না, আমি তাকে জিনিশপত্রগুলো বইতে দিই নি; আমার হাতে এমন কীই বা থাকে। আমি হাতে কোনো ব্যাগ বা বাক্স বইতে পছন্দ করি না; যাদের হাতে ওগুলো থাকে তাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমার; তাদের আমি খুব শ্রদ্ধা করি; আমার অমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে ভয় হয়। আমার হাতে যা থাকে সেগুলো আমি নিজেই বয়ে নিতে পারি; তার জন্যে দারোয়ানটির মতো একটা আস্ত লোক আমার দরকার নয়। কিন্তু লোকটি আজকাল আমাকে দেখতে পায় না কেনো? আমাকে কি আজকাল আগের থেকেও গুরুত্বহীন দেখায়?
আজকাল সে নিজেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে; মুখের চারদিক ঢেকে দাড়ি রেখেছে, মাথায় একটা গোল টুপিও পরছে; লিকলিকে হলেও তাকে বেশ সম্ভ্রান্ত মনে হয়; এজন্যেই হয়তো দাঁড়ায় না, সালাম দেয় না। আমিই হয়তো কোনোদিন তাকে সালাম দিয়ে বসবো। লোকটি যদি না দাঁড়াতো, সালাম না দিতো, আমার যেতে আসতো না–আমি প্রত্যেক মানুষের মর্যাদায় বিশ্বাস করি, তাকে একটি চেয়ার এনে দিতেও মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় আমার; কিন্তু দেখছি আমার একটু যায় আসে, আমি যখন দালানে ঢুকি তখনই দেখতে পাই কেরামতুল্লাহ মিয়াও ঢুকছেন, আর তাকে দেখার আগেই দোরোয়ানটি দাঁড়িয়ে পড়ছে, উঠে বড়ো একটা সালাম দিচ্ছে; কেরামতুল্লাহ মিয়ার। বাক্সটি হাতে নিয়ে তার পেছনে পেছনে চোদো জন্মের চাকরের মতো হাঁটছে। আমি অবশ্য এ-দৃশ্য দেখতে চাই না, দেখেও দেখি না, পেছনে তাকাই না; আমি চোখ আর কান বন্ধ করে ওপরে উঠতে থাকি; কিন্তু আমি সব কিছুই দেখতে আর শুনতে থাকি; আমার সব কিছুই ঠিক থাকে, তবে মনে হয় আমার কিছুই ঠিক নেই। আমি দারোয়ানটিকে ‘তুমি’ই বলি; দেখেছি সে টুলে বসেই আমার কথার জবাব দেয় বা দেয় না; কিন্তু কেরামতুল্লাহ মিয়া তাকে ‘তুই’ই বলেন। আমি শুনতে পাই কেরামতুল্লাহ মিয়া দারোয়ানটিকে বলছেন, অই হারামজাদা, তোর বউ ক্যামন আছে? দারোয়ানটি গলে পড়ছে, সে জানাচ্ছে তার বউ ভালোই আছে; কেরামতুল্লাহ মিয়া জানতে চাচ্ছেন, হারামজাদা, আবার বউর প্যাট বানাইছছ নি? শুনে বিনয়ে দারোয়ানটি সিঁড়িতে মিশে যাচ্ছে, লজ্জায় মুখ খুলতে পারছে না, শেষে বলছে, হ, গরিবগো সখআল্লাদের আর কী আছে, কেরামতুল্লাহ মিয়া বলছেন, তর বউরে একবার দেকতে যামু; দারোয়ানটি বলছে, আমার বউ আপনের কতা প্রত্যেক দিনই কয়। কেরামতুল্লাহ মিয়াকে দারোয়ানটি চোদ্দো পুরুষের প্রভু মনে করছে; যদিও কেরামতুল্লাহ মিয়া আমার বেশ নিচের পদেই আছেন; আমার মুখোমুখি হ’লে বড়ো একটা সালাম দেন; কিন্তু দারোয়ানটি কেনো আমাকে মূল্য দিচ্ছে না?
আমি কি আগামী সকালে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে দারোয়ানটিকে বলবো, এই দাঁড়াও; আমাকে সালাম দাও? সেটা কি শোভন হবে? অন্যরা শুনলে কী ভাববে? ভাববে, না হাসবে? কিন্তু এ-দারোয়ানটিই তো বছরখানেক আগে আমার কাছে এসেছিলো; মেঝেতে মিশে গিয়ে কেরামতুল্লাহ মিয়ার নামে অভিযোগ করেছিলো যে কেরামতুল্লাহ মিয়া তাকে হারামজাদা, বাপের-জন্ম-না বলে গালি দেন, এবং ঘরে নিয়ে তাকে দিয়ে জুতো খোলান, এবং মাঝেমাঝে চড় কষিয়ে দেন, এবং তার ঘরে কোনো কোনো দিন মেয়েলোক এলে কেরামতুল্লাহ মিয়া তাকে দরোজায় দাঁড় করিয়ে রাখেন-এসব অভিযোগ করেছিলো; এবং আমি ব্যাপারটি দেখবো বলে তাকে কথাও দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই দুপুরেই দেখি কেরামতুল্লাহ মিয়া তাকে নিয়ে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন; বলছেন, হারামজাদা, একশোটা ট্যাকা নে; ঈদের বকশিশ। দারোয়ানটি পা ছুঁয়ে সালাম করছে কেরামতুল্লাহ মিয়াকে, এবং বলছে, বউর একটা শাড়ি দরকার। কেরামতুল্লাহ মিয়া বলছেন, একদিন বউ দ্যাকতে লইয়া যাইচ, শাড়ি কিন্না দিমু। আমি আর ব্যাপারটি দেখি নি; দারোয়ানটিও আর চায় না যে আমি ব্যাপারটি দেখি।
কিন্তু দারোয়ানটি আমাকে দেখে দাঁড়ায় না বা সালাম দেয় না, তাতে আমার কী আসে যায়? তবে ভেতরে ভেতরে কেনো আসে যায়? আমি কি লোকটিকে এখান থেকে বদলি করিয়ে দেবো? ইচ্ছে করলে আমি পারি; তাকে যে দেখাশোনা করে, তাকে বললেই দু-একদিনের মধ্যে দারোয়ানটিকে অন্য কোথাও বদলি করে দেবে। কিন্তু আমি কি একটি দারোয়ানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছি? তাকে কি ভেতরে ভেতরে আমার সমান করে তুলেছি? আচ্ছা, দারোয়ানটি কি আমার চেয়ারে বসতে পারতো না? আমি বসতে পারতাম না তার টুলে? আমার খারাপ লাগতে থাকে; ইচ্ছে হয় একবার নিচে নেমে তার কাছে মাফ চেয়ে আসি। আমি নিচে নামি না, মনে মনে মাফ চাই। কিন্তু দুপুরে একবার আমার নিচে নামতে হয়; দেখি দারোয়ানটি টুলে বসে আছে, আমাকে দেখে দাঁড়াচ্ছে না, সালাম দিচ্ছে না।