ডলির কাছে পুরুষ বলতে কি শুধু দেলোয়ারই বোঝায়? না কি আমিও তার অন্তর্ভুক্ত? এতে দেলোয়ারের শ্বাসরুদ্ধ হতো না,–ডলি ভালোভাবেই জানে; দেলোয়ার হয়তো ওই সুগন্ধে বেশি করে বেঁচে উঠতো–আমি ঠিক জানি না, কিন্তু ডলি জানে; আর আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসেছিলো। ডলি ভেতরে চলে যায়; একটু পর তার মা এলে অভ্যাসবশতই আমি দাঁড়িই; তিনি হাত ধরে আমাকে বসান। আমি যেমন অভ্যাসবশত তাঁকে দেখে দাঁড়িই, তিনি কি তেমনি অভ্যাসবশতই আমাকে হাত ধরে বসান? আমাকে দেখে তিনি সুখ পাচ্ছেন–আমি একটু কষ্ট পাই; দেলোয়ারের মা এভাবে আমার হাত ধরতেন না। অমনি নিজেকে আমার অপরাধী মনে হয়; আমি একজনের মায়ের কাছে অপরাধ করেছি বলে আরেকজনের মা সুখী হয়েছেন, যদিও তাকে সুখী করার কথা আমি কখনো ভাবি নি; এখনো ভাবতে পারছি না।
তিনি বলেন, ডলিকে দেলোয়ারদের বাসা থেকে একবারও কেউ দেখতে আসে নি।
আমি বলি, ডলি কি দেলোয়ারদের বাসায় গিয়েছিলো?
তিনি বলেন, না। আমি বারবার যেতে বলছি, ডলি যাচ্ছে না। মনে হয় কোনোদিন যাবে না। তিনি আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, তোমাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছিলো।
আমি বলি, আমার অপরাধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, না, না; তোমার জন্যেই ডলি বেঁচে আছে।
আমি বলি, আমরা দুজনই অপরাধ করেছি।
তাঁর চোখে আমি কয়েক বিন্দু অশ্রু জমতে দেখি; তিনি চোখ মুছতে মুছতে ভেতরে চলে যান।
এবার আমি মাংসমেশানো সুগন্ধটি পেতে শুরু করি;–মহাজগতের কোথাও মাংসের ভেতরে তীব্র সুগন্ধ উৎপাদন শুরু হয়েছে; সে-সুগন্ধ বইতে শুরু করেছে আমাকে ঘিরেই। আজ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে না; আমি আরো সুগন্ধের জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠছি; আমার ভেতর, মাংসের ভেতর, আমার যে-আত্মা নেই, তারও ভেতর ওই সুগন্ধের জন্যে ক্ষুধা জেগে উঠছে।
ডলি ঢুকে জিজ্ঞেস করে, মাংসমেশানো সুগন্ধ কি পাচ্ছেন?
আমি বলি, পাচ্ছি।
ডলি বলে, আজ আপনার কেমন লাগছে?
আমি বলি, এ-সুগন্ধই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
ডলি বলে, আপনার কাছে একটি কথা আমি জানতে চাই, আপনি কি আমাকে বলবেন?
আমি বলি, বলুন।
ডলি বলে, আপনি কি চান আমি সারাজীবন অপরাধবোধের মধ্যে থাকি?
আমি বলি, অপরাধবোধের মধ্যে থাকা খুব কষ্টকর।
ডলি বলে, আমি হাঁপিয়ে উঠেছি; আমি হয়তো আত্মহত্যা করে বসবো।
আমি বলি, আত্মহত্যার কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে, তবে কখনো করে উঠতে পারবো না।
ডলি বলে, মা আমাকে সব সময় জড়িয়ে ধরে রাখতে চায়, বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চান, তাতে আমার মনে হয় আমি অপরাধ করেছি।
আমি বলি, আমারও এমনই মনে হয়। আমি আছি বলে মা এতো সুখী বোধ করছে যে আমার মনে হয় আমি কোনো অপরাধ করেছি।
ডলি বলে, দেলোয়ার আমাকে অপরাধবোধের মধ্যে রেখে গেছে।
দেলোয়ার আমাকে অনেক বছর অপরাধবোধের মধ্যে রেখেছিলো। আমি বলি।
ডলি বলে, সেটা কী?
আপনাকে আমি তা বলতে পারবো না; এখন আমি সেই অপরাধবোধ কাটিয়ে উঠেছি। আমি বলি।
ডলি বলে, দেখে মনে হয় না আপনি কোনো অপরাধ করতে পারেন।
আমি বলি, আমি তো প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো অপরাধ করি।
ডলি বলে, আপনি বাড়িয়ে বলছেন।
আমি বলি, এই যে আমি এখন মাংসমেশানো সুগন্ধ পাচ্ছি, আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো অপরাধ করছি।
ডলি বলে, এই সুগন্ধেই আপনি সেদিন গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন?
আমি বলি, হ্যাঁ।
ডলি বলে, আজ কেমন লাগছে?
আমি বলি, বুক ভরে সুগন্ধ নিতে ইচ্ছে করছে।
ডলি বলে, আপনি অপরাধ করছেন।
আমি বলি, আমি সব সময়ই বোধ করি আমি অপরাধ করছি, কিন্তু বুঝে উঠতে পারি না কী অপরাধ করছি, কার কাছে অপরাধ করছি।
ডলি বলে, আপনার বন্ধুর কাছে।
আমি হাসি, আমার খারাপ লাগে না;–আমি প্রফুল্ল মনেই বেরিয়ে আসি; শহরটিকে আমার সুন্দর মনে হয়। অনেক বছর আমি প্রফুল্লতা–(শব্দটি ঠিক তো? অনেক বছর। আমি শব্দটি ব্যবহার করি নি)–বোধ করি নি; অনেক বছর আমার বুক ঝলমল করে ওঠে নি। কখন থেকে আমি প্রফুল্ল নই? যে-মেয়েটিকে দেখে আমি কেপে উঠতাম, তাকে কেরোলিনের শার্টপরা মামার সাথে বেবিতে কোথায় চলে যেতে দেখার পর থেকে? অদ্ভুত চুল আঁচড়ানো দুলাভাইয়ের সাথে বেবিতে করে কোথায় চলে যেতে দেখার পর থেকে? কেনো আমার প্রফুল্লতা নষ্ট হয়ে যায়? মেয়েটি কি আমাকে কথা দিয়েছিলো সে কারো সাথে বেরিয়ে যাবে না? আমি কি কোনোদিন তাকে বলেছি আপনি কারো সাথে বেবিতে উঠবেন না; আমার সাথে উঠবেন? আমার সাথে মেয়েটি উঠবে কেনো? আমার সাথে দূরে যাবে কেনো? আমি কি তখন থেকেই প্রফুল্লতা হারিয়ে ফেলি? নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পর থেকে? অপবিত্র হওয়ার পর থেকে? আমি আজ কেনো প্রফুল্ল হয়ে উঠছি?
বৃষ্টি নামছে–মসৃণ কোমল উষ্ণ-শীতল নিবিড় সিল্ক নামছে; অনেক বছর আমি বৃষ্টি দেখি নি, ছোঁয়া পাই নি। কেনো দেখি নি, ছোঁয়া পাই নি। বৃষ্টিকে কি আমি প্রতিপক্ষ ভেবেছি? বৃষ্টির ফোঁটা না ঠাণ্ডা আলোর টুকরো এগুলো? আমার মুখে আমার চোখে। আমার চুলে রাশিরাশি আলোর টুকরো জলের টুকরো হয়ে পড়ছে; আমার সঙ্গে শুধু বৃষ্টি আছে, আর কেউ নেই। আমি বৃষ্টির সাথে খেলছি, বৃষ্টি আমার সাথে খেলছে। রাস্তার পাশে কয়েকটি গাছ আমার মতোই প্রফুল্ল, গাছগুলো গলে সবুজ রঙ ঝরে পড়ছে। সবুজ? না কালো? না লাল? না হলদে বুঝতে পারছি না। কতো বছর আমি গাছের নিচে দাঁড়াই নি। কেনো দাঁড়াই নি? আমি গাছগুলোর নিচে গিয়ে দাঁড়াই, গাছের পাতা থেকে রঙ ঝরে পড়ুক, আমার চুলের ওপর পড়ুক, আমার মুখের ওপর পড়ুক। ডলিকে ডেকে আনবো? নারায়ণগঞ্জের মেয়েটিকে? যে-মেয়েটি বেবিতে চলে যেতো, তাকে। বৃষ্টি আরো প্রচণ্ড মধুর অন্তরঙ্গ নিবিড় নামছে। যতোই নামছে, আমি প্রফুল্ল হয়ে উঠছি, বৃষ্টি ততোই নামছে। পৃথিবীতে বৃষ্টি ছাড়া আর কিছু নেই। ওই দিক থেকে একটি মেয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। সেও কি আমার মতোই প্রফুল্ল। তাকে ছুঁয়ে কি বৃষ্টির ফোঁটাগুলোও প্রফুল্ল? মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। না কি আমিই মেয়েটির দিকে এগোতে থাকি? মেয়েটিকে দেখে আমি হাসি; হাত নাড়ি–মেয়েটিকে চেনা মনে হয়, যদিও আগে কখনো দেখি নি; আমাকেও তার চেনা মনে হয়, যদিও আগে কখনো দেখে নি; সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। না কি আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। মেয়েটি আমার হাত ধরে-না কি আমি তার হাত ধরি? হাত ধরাধরি করে আমরা রাস্তার মাঝে দিয়ে দৌড়োই; মেয়েটি খলখল করে হাসতে থাকে; আমরা দৌড়োত থাকি। একবার আমরা রাস্তার ওপর শুয়ে পড়ি। তারপরই হাত ধরাধরি করে আমরা একটি ঝোঁপের ভেতর ঢুকি; আমরা যে ঝোঁপের ভেতরে ঢুকবো আমরা জানতাম না; আমি যখন জানতে পারি মেয়েটি তখন জানতো না, মেয়েটি যখন জানতে পারে আমি তখন জানতাম না; আমরা দুজনই এক সময় এক সাথে জানতে পারি। আমাদের জড়িয়ে ধরে আমরা ঘাসের ওপর গড়িয়ে পড়ি; আমরা খলখল করে হেসে উঠি, আমাদের খলখল হাসি শুনে আমরা আরো খলখল করে হেসে উঠি;–এক সময় আমি সম্ভবত বলে উঠি, কতো লাগবে তোমার–তখন বৃষ্টি আরো কালো আরো শাদা আরো খলখল করে নামে; মেয়েটি আমাকে ঘাসের সাথে মিশিয়ে দিতে দিতে বলতে থাকে, এই বিষ্টিতে টাকা লাগবে না, এই বিষ্টিতে টাকা লাগবে না।