- বইয়ের নামঃ মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ওই ঘটনার আমি অংশ হই
মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ – উপন্যাস – হুমায়ুন আজাদ
উৎসর্গ – ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম
প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৪০২ : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬
ওই ঘটনার আমি অংশ হই আকস্মিকভাবে, আমার তাতে থাকার কথা ছিলো না। আমি, সাধারণত, কোনো কিছুতে থাকতে চাই না; দূরে থাকতে চাই সব কিছু থেকে–দূরে থাকতে পারলে খুব নির্মল একটা শান্তি পাই; কিন্তু আমি কেমন করে যেনো জড়িয়ে পড়ি, জড়িয়ে পড়ার পর আমারও মনে হতে থাকে যেনো আমি সুপরিকল্পিতভাবেই ওই সবে থাকতে চেয়েছিলাম। দেলোয়ার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ;–অনেক বছর খুব কাছাকাছি ছিলাম আমরা, এতো কাছাকাছি যে দুজনকে সব সময় একই সাথে দেখা যেতো; কিন্তু ওই ঘটনার কয়েক বছর আগে থেকে আমরা বেশ দূরে সরে গিয়েছিলাম। দূরে সরে যাওয়াটা বিদ্বেষ বা বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য ঘটে নি–(আমরা সব সময়ই পরস্পরকে ভাবতাম, কোনো পরিচিতের সাথে দেখা হলেই আমি দেলোয়ারের আর দেলোয়ার আমার কথা বলতো); ঘটেছিলো আমরা ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছিলাম বলে। নিজের পেশায়, ব্যবসায়, অত্যন্ত সফল হয়েছিলো দেলোয়ার; তিরিশ বছর বয়সেই যা সে উপার্জন করেছিলো, আমি তা আজো করার স্বপ্নও দেখি না। ওই বছর দেলোয়ার বিয়ে করে। বিয়ের মঞ্চে দেলোয়ারের বউকে দেখে আমি একটু কেঁপে উঠি, সামান্য একটু কাঁপন;–আমার চোখ তার বউয়ের চিবুকের ওপর গিয়ে পড়েছিলো, একটি কাঁধের ওপর গিয়ে পড়েছিলো; তা আমাকে কম্পিত করে, কিছুটা ঈর্ষারও জন্ম দেয়; এবং আমি ভয় পাই। এটা অবশ্য নতুন নয়; অন্য কয়েকটি বিয়ের আসরেও আমার এমন হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে রূপসী বউ দেখে আর নিজের কথা ভেবে কে না কাঁপন আর ঈর্ষা বোধ করে; আর অসুন্দর বউ দেখে কে না সুখ পায়। আমার কাঁপন আর ঈর্ষা ছিলো অল্প সময়ের জন্যে;–তা অচিরেই কেটে যায়; দু-তিন দিনের মধ্যেই আমি ভুলে যাই যে আমার বন্ধু দেলোয়ারের বউ অত্যন্ত রূপসী। কিন্তু ভয়টা আমার সঙ্গে থেকে যায়; আমি যে দেলোয়ারের বউর চিবুক আর কাঁধের ওপর চোখ ফেলেছি; এতে আমার ভয় লাগতে থাকে, অপরাধ বোধ হ’তে থাকে;–অনেক বছর আমি কোনো নারীর শরীরের ওপর এমনভাবে চোখ ফেলি নি।
বিয়ের পর আরো দু-তিনটি অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত হই; এবং আমি যাই নি এমন নয় যে ওই দিনগুলোতে আমার আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ, বা আরো আনন্দয়ক উৎসবে নিমন্ত্রণ ছিলো। আমি যাই নি;–কেনো যাই নি, আমি নিজেও বুঝি নি। আমার কি ভয় হচ্ছিলো যে গেলে আমার চোখ আবার দেলোয়ারের বউর চিবুক বা কাঁধের ওপর গিয়ে পড়বে? বা পড়বে আরো ভয়ঙ্কর কোনো জায়গায়;–নতুন বিয়ের পর বউদের ভয়ঙ্কর জায়গাগুলো থেকে মাঝেমাঝেই কাতান বেনারসি জর্জেট খসে পড়ে, খসে পড়লেই তাদের আরো সুন্দর দেখায়–এবং আমি আবার কাঁপন আর ঈর্ষা বোধ করবো? না কি বউ ব্যাপারটিই ভীত করতে আমাকে বউ ব্যাপারটি মনে হলেই আমার অন্যদের কথা মনে হতো; কখনো নিজেকে মনে পড়তো না; বউ এবং নিজেকে জড়িয়ে আমি কিছু ভাবতে পারতাম না। আমি দেলোয়ারের ওই অনুষ্ঠানগুলোতে যাই নি; না যাওয়ার জন্যে আমার মনে ক্ষীণ অপরাধবোধ জন্ম নেয়। দেলোয়ারের সাথে আমার তো দেখা হবেই, দু-এক দিনের মধ্যে না হোক দু-এক মাসের মধ্যে হবেই; তখন আমি কী জবাব দেবো? তখন থেকে দেলোয়ার আর তার বউ ডলির কথা আমার সব সময় মনে পড়তে থাকে; মনে হতে থাকে এই বুঝি দেলোয়ার আমার বাসায় বা মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ অফিসে আসছে; এই বুঝি টেলিফোন করছে; এবং আমি ভয় পাই। একরাতে আমি ডলিকে স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নে আমি ডলির চিবুক বা কাঁধ দেখি না; পেছন দিক থেকে তার দীর্ঘ গ্রীবা আর প্রশস্ত পিঠ দেখি, এবং ঘুম থেকে জেগে উঠি। বন্ধুর নতুন বউকে স্বপ্নে দেখা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না; তারপর সারারাত আমি আর ঘুমোতে পারি না।
এক ছুটির দিন, ভোরবেলা, যখন আমি ঘুম থেকে জেগে গড়াচ্ছি, চা খাচ্ছি, গড়াচ্ছি, সিগারেট টানছি, আমার ভালো লাগছে, পুরোনো প্লেবয়ের পাতা উল্টোচ্ছি, চা খাচ্ছি, আমার ভালো লাগছে না কিন্তু ভালো লাগছে, বেলা দশটা বেজে যাচ্ছে, অনেক কিছু আমার মনে পড়ছে এবং অনেক কিছু আমার মনে পড়ছে না, তখন দেলোয়ার তার বউকে নিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে উপস্থিত হয়। একরাশ সুগন্ধ ঝড়ের বেগে আমার দরোজা দিয়ে ঢুকছিলো; তাতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম দেলোয়ার তার বউকে নিয়ে এসেছে। দেলোয়ার যে একদিন আসবে, তাতে আমি নিশ্চিত ছিলাম। কেনো নিশ্চিত ছিলাম? আমি কি কোনো অলৌকিক পরিকল্পনা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলাম কোনোখানে, যা অনুসারে দেলোয়ারকে আমাদের ফ্ল্যাটে আসতেই হতো? ও-ধরনের কিছু আমি করি নি, করার শক্তি আমার নেই; কিন্তু আমি জানতাম দেলোয়ার তার বউকে নিয়ে একদিন আসবেই। সুন্দর দামি জিনিশ, আমার মনে হতো, কেউ কখনো একলা উপভোগ করে সম্পূর্ণ তৃপ্তি পায় না; আর দেলোয়ার তো আমাকে ছাড়া কিছুই উপভোগ করে সুখ পেতো না। দেলোয়ার তার রূপসী বউকে নিশ্চয়ই উপভোগ করছে; কিন্তু আমার মনে হতো আমাকে বাদ দিয়ে তার উপভোগ কখনো সম্পূর্ণ হবে না; তার উপভোগকে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্যে একদিন বউকে নিয়ে আমার কাছে আসতেই হবে; এবং দেলোয়ার এসে উপস্থিত হয়। আমি তার বউর দিকে তাকাতে পারি না। বিয়ের পর বউদের মাংস আর চামড়ায় অদ্ভুত রঙ লাগে; তারা ঢলঢল করতে থাকে–এটা আমার ছেলেবেলায় দেখা, পরে আর আমি কোনো নতুন বউর দিকে ভালো করে তাকাতে পারি নি; দেলোয়ারের বউর চামড়ায়, আমি দেখতে পাই, সোনার হাল্কা প্রলেপ লেগেছে; তার কোমল আদুরে চর্বি চামড়া ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। দেলোয়ারের বউর চামড়ার ভেতর দিয়ে একটি শ্রাবণের নদী বইছে। কারো পক্ষে ওই সৌন্দর্য একলা উপভোগ করা সম্ভব নয়। দেলোয়ার নিশ্চয়ই ওই সৌন্দর্য উপভোগের সময় নীরবে চিৎকার করে ওঠে; নিজেকে মহাশূন্যে-খসে-পড়া পালক বলে মনে করে; ওই সৌন্দর্য উপভোগের সময় বারবার মরে যেতে যেতে বেঁচে ওঠে, কিন্তু কখনো সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করতে পারে না।