ভাবতে ভাবতে রোদে-ভরা উঠোন পেরোতে থাকে শ্রীনাথ। সোমনাথের দুরবস্থার কথা চিন্তা করতে করতে আপনমনে হাসে। চাকরির জমানো টাকা খরচ করে দেওয়ানি মামলা লড়তে গিয়ে ফতুর হয়ে যাচ্ছে বেচারা। তৃষার ধান-বেচা অগাধ টাকা তো ওর নেই। যখন মামলায় হারবে তখন মাথায় হাত দিয়ে বসবে। বেচারা! সোমনাথ মরিয়া হয়ে এমন কথাও বলে বেড়াচ্ছে মল্লিনাথকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সম্পত্তি বাগাবার জন্য তৃষা তার ভাসুরের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক। পাতিয়েছিল।
এ কথাও কি উড়িয়ে দিতে পারে শ্রীনাথ? রোদ থেকে বাগানের ছায়ায় পা দিয়েই সে থমকে দাঁড়ায়। অবৈধ সম্পর্কের কথাটা মনে হতেই তার শরীর গরম হচ্ছে। রক্তে উথাল পাথাল। সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কামভাব। আশ্চর্য এই, তৃষাকে সে সন্দেহ তো করেই, তার ওপর সেই সন্দেহ থেকে একটা তীব্র আনন্দও পায়।
পুকুরপাড়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে না? সজল কি? কয়েক পা এগিয়ে গেল শ্রীনাথ। চোখের দৃষ্টি এখন আগের মতো তীক্ষ্ণ নেই। তবু মনে হল সজল। মাছ ধরছে।
নিঃসাড়ে এগিয়ে যায় শ্রীনাথ।
জলের খুব ধারে দাঁড়িয়ে আছে সজল। সাঁতার জানে না। পাশে ঘাসের ওপর কম করেও পাঁচ-ছ’টা মাছ পড়ে আছে। কেউ খায় না। ধরছে কেন তবে?
খুবই রেগে গেল শ্রীনাথ। এমনিতেও তুষার আশকারা আর আদরে বেহেড এই ছেলেটাকে তেমন পছন্দ করে না শ্রীনাথ। একটু আগেই মঞ্জু বলছিল, মাকে বলে দিদিদের মার খাওয়ায়। ছেলেটা।
শ্রীনাথ আচমকা পিছন থেকে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে, কী করছ?
একটা মস্ত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। চমকে কেঁপে উবু হয়ে পড়ে যেতে যেতে কষ্টে সামলে নিল সজল। ভয়ে সাদা মুখ ফিরিয়ে তাকাল! তার সামনে খাড়াই পাড় ছিল। অন্তত সাত-আট ফুট নীচে জল। পড়লে খুব সহজে ওঠানো যেত না। পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে শ্রীনাথ একটু লজ্জিত হয়। ঠান্ডা গলায় বলে, মাছ ধরতে কে বলেছে?
সজল আস্তে করে বলে, কেউ বলেনি।
ছেলের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাসের দরুন কী বলবে তার ভাষা ঠিক করতে পারে না শ্রীনাথ। গম্ভীর মুখে বলে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। তুমি কি সাঁতার জানো?
না।
তা হলে পুকুরের ধারে আর কখনও এসো না।
ঘাড় কাত করে ভাল মানুষের মতো সজল বলল, আচ্ছা।
তারপর ছিপ গোটাতে লাগল।
শ্রীনাথ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তুমি মায়ের কাছে দিদিদের নামে নালিশ করো?
সজল সেই রকমই ভয়ার্ত মুখে বাবার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, না তো!
আজই করেছ।
সজল মৃদু স্বরে বলে, দুধে সর ছিল। তাই বলেছিলাম।
তুমি দুধের সর খাও না?
সজল মাথা নাড়ে। না।
শ্রীনাথ একটু হেসে বলে, সর তত ভাল। পুষ্টি হয়।
ঘেন্না লাগে।
শ্রীনাথ একটু চেয়ে থেকে কী বলবে ভাবে। তারপর খাস ছেড়ে বলে, যারা রোজ দুধ খায় তারা বুঝবে না একটুখানি ঘেন্নার সর কত ছেলের কাছে অমৃতের মতো।
সজল কথাটা হয়তো বুঝল না, কিন্তু টের পেল যে, বাবা তার ওপর খুশি নয়। তার মুখে-চোখে ডাইনি বুড়ি দেখার মতো অগাধ অসহায় ভয়। শ্রীনাথের মনে পড়ল, এক সময়ে ট্যাম-গোপালের নাম করলে সজল ভয় পেত খুব! আজ তার বাবাই তার কাছে সেই ট্যাম-গোপাল।
শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করে, আমার সম্পর্কে তোমাকে কি কেউ ভয় দেখিয়েছে?
না-তো!–তেমনি ভয়ে ভয়েই বলে সজল।
তবে ভয় পাচ্ছ কেন?
সজল হাতের ছিপটার দিকে চেয়ে থাকে মাথা নিচু করে।
শ্রীনাথ একটু মজা করার জন্য বলে, আমার তো শিং নেই, বড় বড় দাঁত নেই, থাবা নেই। তবে?
সজল এ কথায় একটুও মজা পেল না। তার মুখ রক্তশূন্য, চোখে কোনও ভাষা নেই। এই অসহায় অবস্থা থেকে ওকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই শ্রীনাথ বলে, যাও। তোমাকে কিন্তু আমি বকিনি। সাবধান করে দিয়েছি মাত্র। ওই মাছগুলো এখন কী করবে?
কিছু করব না।
বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলে, কিছু করবে না তো কি ফেলে দেবে? বরং খ্যাপা নিতাইকে দিয়ে। সে বেঁধে খাবেন। নইলে গরিব-দুঃখী কাউকে দিয়ে দিয়ে যাও।
সজল চলে গেলে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে ইস্পাতের আনা সেই গো-হাড়টা নজরে পড়ে শ্রীনাথের। কাঁচা হাড়। এখনও মাংস লেগে আছে। ঘেন্নায় গা বিরিয়ে ওঠে। আর সেই সঙ্গেই আবার গুপ্ত কাম-ভাবটা মাথা চাড়া দেয়।
ঘরটা হাট করে খোলা। মঞ্জু নেই। শ্রীনাথ তার ইজিচেয়ারে বসে খানিক বিশ্রাম করে। তারপর উঠে জামাকাপড় পরতে থাকে।
শ্রীনাথের চাকরিটা খুবই সামান্য। এত ছোট চাকরি যে, নিজেকে নিয়ে একটু অহংকার থাকে না। একটা মস্ত বড় নামী প্রেসে সে প্রুফ দেখে। বেতন যে খুব খারাপ পায় তা নয়। কিন্তু এ চাকরিতে কোনও কর্তৃত্ব নেই, উন্নতির সম্ভাবনা নেই, উপরন্তু সারা বছরই প্রচণ্ড খাটুনি।
তারা সব ক’জন ভাই-ই ছিল ভাল ছাত্র। শ্রীনাথ একান্ন সালে ফাস্ট ডিভিশনে অঙ্ক আর সংস্কৃতে লেটার পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করে। আই এস-সিতে লেটার না পেলেও ডিভিশনটা ছিল। বি এস-সিতে পাসকোর্সে ডিস্টিংশন পায়। কিছু লোক আছে যাদের পাথরচাপা কপাল। বি এস-সি পাশ করে কিছুদিন মাস্টারি করেছিল শ্রীনাথ। তখন মনে হত, একদিন নিশ্চয়ই সে এসব ছোটখাটো পরিমণ্ডল ছেড়ে মস্ত কোনও কাজ করবে। মফসসল ছেড়ে কলকাতাবাসী হওয়ার জন্য একদা মাস্টারি ছেড়ে প্রেসের চাকরিটা নিয়েছিল সে। তখনও ভাবত, এ চাকরিটা নিতান্তই সাময়িক। বড় চাকরি পেলে এটা ছেড়ে দেবে। সেই ছাড়াটা আর হয়ে উঠল না। একটা জীবন বড় কষ্টে কেটেছে। দাদা মল্লিনাথ ছিল মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু একটু খ্যাপাটে স্বভাবের দরুন এক চাকরি বেশিদিন করত না। তারপর একদিন খেয়ালের বশে মারকিনি কায়দায় র্যনিচ বা খামারবাড়ি বানিয়ে চাষবাস করে একটা বিপ্লব ঘটানোর জন্য এইখানে চলে এল। উন্মার্গগামী ও অসম্ভব সুপুরুষ মল্লিনাথকে ভালবাসত সবাই। সে বিবাহে বিশ্বাসী ছিল না, কিন্তু একটু হয়তো মেয়েমানুষের দোষ ছিল। প্রচণ্ড মদও খেত। খুব খাটত, অনিয়ম করত, শরীরের যত্ন নিত না। ছুটির দিনে শ্রীনাথ সপরিবারে বেড়াতে এলে মলিনাথ তাদের ছাড়তে চাইত না। তৃষাকে এটা ওটা রান্নার ফরমাশ করত। তৃষা সেই পাগল লোকটার মনস্তত্ত্ব বুঝতে পেরেছিল জলের মতো। স্বামীর চেয়েও বেশি যত্ন করত তাকে। এমনও হয়েছে ছেলেমেয়ে সহ তৃষাকে এখানে চার-পাঁচ দিনের জন্য রেখে কলকাতায় ফিরে গেছে শ্রীনাথ। সেই সব দিনের কথা ভাবতে চায় না সে এখন আর। ওই সব দিনগুলি তার বুকে বিশাল বিশাল গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। কালো রহস্যে ঢাকা গহ্বর সব। আজও সে একা বসে বসে সেই সব কথা ভাবে আর শিউরে ওঠে গা। তখন ব্যাপারটা অসংগত মনে হত না কেন যে! এখন মনে হয়, কী সাংঘাতিক ভুলটাই সে করেছিল। তখন গরিব ছিল সে। বড়ই গরিব। মলিনাথ দেদার সাহায্য করত। ছেলেমেয়েরা এখানে এলে ভাল খাওয়া পেত, পরিষ্কার জলবায়ু পেত। অন্য দিকটা তখন কিছুতেই চোখে পড়ত না শ্রীনাথের।