রাশেদ কি বেরিয়ে পড়বে নরক থেকে বেরিয়ে গেলে কি স্বর্গের ধুলোকণার ওপর পড়বে তার পঙ্কিল পদযুগল? চারপাশে কি স্বর্গ ছড়িয়ে আছে? নাকি অতল আবর্জনায় পড়ে সে তলিয়ে যাবে, তার চিৎকারও কারো কানে গিয়ে পৌঁছোবে না? পান শুরু হয়ে গেছে, নাচছেও কেউ কেউ, উঠতিরা মন্ত্রী দুটিকে ঘিরেই নাচতে চেষ্টা করছে; নাচ রাশেদের সব সময়ই ভালো লাগে, এখনো লাগছে, দুটি আমলা এরই মাঝে দুটি উঠতিকে বাহুর ভেতরে ভরে ফেলেছে, সাধনা করছে আন্ডারওঅ্যারের ভেতর ভরে ফেলতে, তখন তারা হয়তো এ-কক্ষে থাকবে না। দুটি ঢলঢলে কলকলে টলটলে উঠতি সম্ভবত মন্ত্রী দুটির জন্যেই বরাদ্দ, আমলাগুলো সে-দুটিকে বাহুতে টানতে চেষ্টা করছে না, বারবার মন্ত্রী দুটির কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, আমলারা মহর্ষিদের থেকেও নিষ্কাম হতে পারে কখনো কখনো, কিন্তু মন্ত্রী দুটি মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে নাচতে অভ্যস্ত নয়। তারা দাঁড়িয়ে থাকছে, পান করছে, উঠতি দুটি তাদের সামনে অল্প অল্প নাচছে, তারা মাঝেমাঝে উঠতি দুটির বাহু পরখ করছে, গাল পরখ করছে, একটু পরে হয়তো তাদের উপচানো চাঁদ দুটিকেও পরখ করবে। একটু দূরেই পানির ওপর যে-দালানটি দাঁড়িয়ে। আছে, সেটি কাত হয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে রাশেদের,তার শেকড় ঘেঁড়ার শব্দ পাচ্ছে রাশেদ,-পানির ওপর যা ভাসে তার কি শেকড় থাকে,-রাত শেষ হওয়ার আগে সারাটি দেশের মাথার ওপর ওটি ভেঙে পড়বে; তবে ওটি হয়তো ভেঙে পড়বে না, ওটি এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রাশেদ আজ রাতে পান করবে না, কেনো পান করবে না; সেও কি পান করাকে খারাপ মনে করে, সে কি মনে করে পান করলে নষ্ট হবে একুশের পবিত্রতা? রাশেদ কয়েকটি বোমার শব্দ শুনতে পেলো মনে মনে, বোমা এবং পান, পান এবং বোমা, কোনটিকে সে বেছে নেবে? আজ সন্ধ্যায় রফিক যদি ময়লা সাফ করার উদ্দেশ্যে তার ওখানে গিয়ে না উঠতো, তাহলে সে এ-সংকটে পড়তো না, কোনো। বাছাবাছি তাকে পীড়িত করতো না, সে একটা সৎ মানুষ থেকে যেতো। এখনো সে। গ্লাশ হাতে তুলে নেয় নি, নেবে কিনা ভাবছে, এমন সময় সে-মন্ত্রীটি, যে আগে তাকে ভাই ভাই করতে, এসে তার পাশে বসলো। সে কাঁপতে শুরু করেছে, গলা জড়িয়ে আসছে তার, তবে অনেক কথা বলতে চায় বলে মনে হচ্ছে। প্রথমেই বললো যে রাশেদকে ওখানে দেখবে বলে সে ভাবে নি। রাশেদ বিব্রত বোধ করে বললো যে এমন ভালো ভালো জায়গায় সেও কখনো কখনো আসে, বলে হাসলো। মন্ত্রীটি আর কথা। বলছে না, কাঁপছে, সে এখন তার বরাদ্দ উঠতিটির দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাচ্ছে, আর বলছে যে ওই ছেমরিগুলো খুব গরম দ্রব্য, সে অবশ্য দ্রব্য শব্দটি ব্যবহার করে নি, রাশেদের লাগলে রাশেদ যেনো তাকে বলে। রাশেদের লাগবে না। মন্ত্রীটি দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, আর রাশেদের হাত ধরে বলছে, ভাই, রাজনীতিবিদগুলোরে যেই জাত বিশ্বাস করে, সেইটা একটা হারামজাদা।
রফিক ওই পাশে বেশ ব্যস্ত, কিন্তু আপাকে সে ভুলতে পারছে না মনে হচ্ছে, রাশেদ বেরিয়ে পড়লো রফিককে কিছু না বলেই; তাকে অনেক দূর যেতে হবে, যদিও কতো দূর যেতে হবে, সে জানে না। পানির ওপর ভয়ঙ্করভাবে দাঁড়ানো দালানটির দিকে। তাকিয়ে নির্বোধ মনে হলো নিজেকে, নির্বোধের মতোই কিছুক্ষণ আগে তার মনে। হয়েছিলো দালানটি কাঁপছে, শেকড় ছেঁড়ার ভুল শব্দও সে শুনতে পেয়েছিলো; এ-সবই যারপরনাই বাজে কথা, দালানটি চমৎকার আছে, চমৎকার থাকবেও, দালানটির ছাদে উঠে যদি আজ রাতে উদ্দিন মোহাম্মদ তার সব উপপত্নী আর চাকরবাকর নিয়ে পান। করতে করতে নাচতে থাকে, তাহলেও ওটি কাঁপবে না। একবার সে ঢুকেছিলো দালানটির ভেতরে, আর ঢুকবে না; ভেতরে ঢুকেই তার মনে হয়েছিলো বিক্রমপুরের এক চাষী সে ভুল করে ঢুকে পড়েছে রাজাদের প্রাসাদে, সে পথ চিনতে পারছে না, বারবার পথ হারিয়ে ফেলছে; চারদিকে দেখতে পাচ্ছিলো রাজাদের, রাজারা খুব ব্যস্ত ছিলো নিজেদের নিয়ে; তারা বলছিলো নিজেদের প্রাসাদের কথা, রানীদের অলঙ্কারের কথা, মুকুটের কথা, তাকে দেখতেই পাচ্ছিলো না রাজারা; যদি সব গ্রামের সব চাষী এখানে ঢুকে পড়তো, তাহলেও রাজারা তাদের দেখতে পেতো না। সে আর ওই খোঁয়াড়ে ঢুকবে না, ওটি ভাঙবে না, ভাঙলেও তার কিছু যায় আসে না; তাকে এখন। অনেক দূরে যেতে হবে। তবে সে বেশি দূরে এগোয় নি, এখনো মাঠও পেরোতে পারে নি; চারপাশ খুব অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে, সে হয়তো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে, খুব বেশি দূরে যেতে পারবে না। একপাল বাঙালি শুয়ে আছে রাস্তার ওপর, দু-তিনটি পুলিশ লাঠি দিয়ে তাদের নিম্নভাগের ছেঁড়া কাপড় উঠিয়ে তাদের নিম্নাঙ্গের রূপরেখা পরীক্ষা। করছে; লোকগুলো খুব ঘুমোতে পারে, সুখী বাঙালি, পুলিশের লাঠির খোঁচায়ও তাদের ঘুম ভাঙছে না, তারা এমনভাবে ঘুমোচ্ছে যাতে লাঠি দিয়ে কাপড় উঠিয়ে তাদের। নিম্নঙ্গের রূপরেখা পরীক্ষা করতে পুলিশের অসুবিধা না হয়। এ-মাঝরাতে পুলিশ কি বেরিয়েছে এ-বাঙালিদের নিম্নাঙ্গের সম্পদ পাহারা দিতে, যা খোয়া গেলে দেশের খুব। ক্ষতি হয়ে যাবে? পুলিশদের ভেতরে প্রেমের দেবতা শক্তভাবে জেগে উঠেছে মধ্যরাতে, কাপড় সরিয়ে তারা প্রেমের মন্দির খুঁজছে। একটি মন্দির পাওয়া গেলো এই মাত্র, তার রূপরেখা পছন্দ হয়েছে আইনশৃঙ্খলার, ওই রূপরেখাকে এখন জেগে উঠতে হবে, কিন্তু সে জেগে উঠতে চাইছে না, যেতে চাইছে না আইনশৃঙ্খলার সাথে; তবে তাকে যেতে হবে, তার রূপরেখা পছন্দ হয়েছে আইনশৃঙ্খলার। আরো কয়েকটি রূপরেখা তাদের। দরকার নিশ্চয়ই, এখানে না পাওয়া গেলে অন্য কোথাও পাওয়া যাবে। কিন্তু রাশেদকে। অনেক দূরে যেতে হবে, যদিও সে জানে না কতো দূর যেতে হবে। রাশেদের ইচ্ছে করছে এদের পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা কি তা অনুমোদন করবে? তারা যদি লাঠি দিয়ে তার নিম্নাঙ্গের রূপরেখা পরীক্ষা করতে এসে দেখে তার জিন্স। ওপরের দিকে উঠছে না, তার রূপরেখা দেখা যাচ্ছে না, তখন নিশ্চয়ই একটা সোরগোল পড়বে। তার চেয়ে হাঁটাই ভালো, খুব ভালো খুব দূরে চলে যাওয়া।