দু-দিন পর বিকেলবেলা আজিজ মাঝপুকুর থেকেই রাশেদকে ডাকতে থাকে, তার কোশানৌকাটি ভিড়োয় রাশেদদের উত্তরের ঘাটে, একটা খবর আছে বলে রাশেদকে তুলে নেয়। বছর দুয়েক বড়ো আজিজ তার থেকে, একই ক্লাশে পড়ে তারা, দু-এক বিষয়ে ফেল করে ওপরের ক্লাশে ওঠে আজিজ, কিন্তু তার জ্ঞানের শেষ নেই; বইয়ের বাইরে যতো জ্ঞান আছে সবই আছে তার, নতুন নতুন জ্ঞান সে নিয়মিত দেয়। রাশেদকে। ওই জ্ঞানে রাশেদ চঞ্চল বিহ্বল কাতর হয়ে ওঠে। এইটে ওঠার পর থেকেই রাশেদের চোখে সবচেয়ে বিস্ময়কর লাগছে মেয়েদের, মিশরের পিরামিড ব্যাবিলনের। শূন্যোদ্যান ওই বিস্ময়ের কাছে হাস্যকর, কিন্তু তা সে কাউকে বলতে পারছে না, আজিজ ওই বিস্ময়কে, কোনো কোনো বিকেল আর দুপুরবেলা, করে তুলছে আরো রহস্যময়, আরো চাঞ্চল্যকর, এমনকি ভয়াবহ। মেয়েদের বুক প্রথম কুলের মতো ওঠে, তারপর সফেদার মতো হয়, তারপর হয় কৎবেলের মতো, এ-জ্ঞান আজিজ তাকে দিয়েছিলো কিছু দিন আগে, রাশেদ কয়েক রাত সহজে ঘুমোতে পারে নি, সে চারদিকে দেখতে পাচ্ছিলো কুল সফেদা কৎবেলের বাগান, পৃথিবীটা ফলের বাগান হয়ে উঠেছিলো তার। চোখে। আজো নিশ্চয়ই আজিজ কোনো রহস্য খুলে দেবে তার সামনে, তার জন্যে মনে মনে সে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। চারপাশে ভাদ্রের ভরা জল, আজিজ নৌকো বেয়ে ঢুকছে। আমন ধানখেতের ভেতরে, সবুজ ঘাসফড়িং লাফিয়ে যাচ্ছে ধানের পাতা থেকে পাতায়, বিকেলের রোদ গলে পড়ছে। আজিজ রাবুর মার কথা বলে; শুনে রাশেদ চমকে ওঠে, দু-দিন আগে বিলু আপারা তো রাবুর মাকে নিয়েই কথা বলছিলো। তারাও কি সংবাদ পেয়ে গেছে, যা পেতে আজিজেরও দেরি হয়েছে দু-দিন? আজিজ বলে রাবুর মার পেট হয়েছে। এতে রাশেদ একটুও চমকে ওঠে না, পেট হওয়া কাকে বলে সে জানে; কথাটি শুনলে তার ঘেন্না লাগে, রাবুর মার কথা শুনেও তার ঘেন্না লাগলো, আজিজ আশা করেছিলো রাশেদ চমকে উঠবে। রাশেদ চমকে না ওঠায় আজিজ বিস্মিত হয়। রাশেদ বলে যে বিয়ে হলে পেট সব মেয়েরই হয়, রাবুর মার পেট হওয়া এমন কী সংবাদ, তাদের গ্রামের মেয়েদের তো বছর ভরেই পেট হচ্ছে। আজিজ হাঁ হাঁ করে ওঠে, রাশেদ যে আস্ত বোকা তাতে তার সন্দেহ থাকে না; আজিজ বলে, বিয়ে হলে পেট হয় ঠিকই, তবে স্বামী বাড়িতে থাকলে হয়, স্বামী বাড়ি না থাকলে হয় না। এটা এক বিস্ময়জাগানো নতুন জ্ঞান রাশেদের কাছে; সে মনে করতো বিয়ে হলেই মেয়েদের বছর বছর পেট হয়, কুমড়োর মতো পেট ফুলে ওঠে, কুৎসিত দেখাতে থাকে, তাদের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। রাশেদের ভেতরে এক অস্থির ব্যাকুলতা দেখা দেয়, সে জানতে চায় স্বামী বাড়িতে থাকতে হবে কেনো? আজিজ অনেকক্ষণ ধরে, আস্তে আস্তে, ব্যাখ্যা করে; বলে, বিয়ে হলেই হয় না, স্বামীকে স্ত্রীর ভেতরে একটা কাজ করতে হয়, কাজের সময় স্ত্রীর পেটে স্বামীর ভেতর থেকে মণি ঢোকে, তবেই পেট হয়। কীভাবে ঘটনাটি ঘটে, তাও বর্ণনা করে আজিজ, তার হাতঠোঁটমুখ কাঁপতে থাকে, মোচড় দিয়ে উঠতে চায় রাশেদের শরীরটিও; সে বলে যে রাবুর বাবা দেশে থাকে না, দশ বছর ধরে দিনাজপুর থাকে, তাই অন্য কারো সাথে কাজের ফলে রাবুর মার পেট হয়েছে। ঠিকই রাবুর বাবা দেশে থাকে না, তবে রাশেদের মনে প্রশ্ন জাগে, রাবুর বাবা যদি দশ বছর আগে রাবুর মার পেটে মণি ঢুকিয়ে গিয়ে থাকে? কথাটি বলতেই আজিজ হাঁ হাঁ করে ওঠে আবার, বলে, দশ বছর আগে ঢোকালে হয় না, প্রত্যেকবার নতুন করে ঢোকাতে হয়। আজিজ বলে যে রাবুর বাবা দেশে আসে না, তার দিনাজপুরে আরেক বউ আছে; রাবুর মার সাথে বারেক স্যারের প্রেম, বারেক স্যার রাতে ওই বাড়িতেই থাকে, তাই পেট হয়েছে রাবুর মার। প্রেম শব্দ আরো দু-একবার শুনেছে রাশেদ, খুব ভণ্ডকথা এটা, শুনে রাশেদের শরীর কেঁপে ওঠে; ভাব হলেও চলতো, ভাব মনের ব্যাপার, কিন্তু প্রেম, এটা অত্যন্ত ভণ্ডকথা। ভাদ্রের বিকেলে রাশেদ একটা জ্ঞান লাভ করে, আদম যেমন লাভ করেছিলো; বই পড়ে যখন সে কোনো জ্ঞান লাভ করে তখন সে এমন থরথর করে। কাঁপে না, ভেতরটা এমন গনগন করে না, কিন্তু আজিজের জ্ঞান তাকে ভূমিকম্পের মতো কাঁপায়, যা চলতে থাকে কয়েক দিন ধরে। বাচ্চা কী করে হয় সে মাঝেমাঝেই। ভাবে, বুঝে উঠতে পারে না, কারো কাছে জিজ্ঞেসও করতে পারে না। আজিজই একবার। তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো স্বামীরা বউদের পেটে মণি ঢুকিয়ে দেয়, তাতে পেট হয়, বাচ্চা হয়। জিনিশটা কেমন রাশেদ জানে না, তবে খুব ঘেন্না লেগেছিলো তার, খুব নোংরা জিনিশ হবে বলে তার সন্দেহ হয়েছিলো। তার ধারণা হয়েছিলো বিয়ের পর স্বামীরা। বউদের পেট কানায় কানায় ওই নোংরায় ভরে দেয়, আর ওই নোংরা থেকে বছর বছর। বাচ্চা হয়।
রাশেদ জানে একজনের বউয়ের পেটে আরেকজনের, বা বিয়ে না করে, মণি। ঢোকানো বড় অপরাধ, জেনা,-আজিজই তাকে জেনা কথাটি শিখিয়েছিলো, ওই অপরাধের জন্যে পুরুষ আর মেয়েলোকটিকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে হয়। খুব ভয়। পেয়েছিলো রাশেদ, অনবরত পাথর ছোঁড়া দেখতে পেয়েছিলো চোখের সামনে। এটা। বড়ো কলঙ্ক; এমন কলঙ্ক হলে মুখ দেখানো যায় না, পুরুষেরা পালিয়ে আসাম ত্রিপুরা চলে যায়, মেয়েরা গলায় ফাঁসি দেয়, কলসি বেঁধে পানিতে ডুবে মরে, যেমন ফাঁসি দিয়ে মরেছিলো কেরানিবাবুর মেয়ে। রাশেদ কখনো তাকে সামনে থেকে দেখে নি, দূর থেকে দেখেছে, শুধু শুনেছে তার ফাঁসির কথা। তার অনেক বয়স হয়েছিলো, বিয়ে হয়। নি বলেই সে ফাঁসি দিয়ে মরেছে, এমন কথা শুনেছিলো রাশেদ; তবে রাশেদ বড়োদের ফিসফিস করে কথা বলাও শুনেছে। রাবুর মাও কি ফাঁসি দিয়ে মরবে? তবে কলঙ্ক থেকে, রাবুর মার ম’রে-যাওয়া থেকে, রাশেদকে বেশি পীড়িত করছে ওই ব্যাপারটি। আজিজ যেভাবে বর্ণনা করেছে তাতে তার জগত ঘিনঘিনে হয়ে উঠেছে, ভাদ্রের ধানখেত ভরা জল সোনালি রোদ নোংরায় ভরে যাচ্ছে। বিলু আপার বিয়ে হলেও কি অমন কাজ করবে সেই লোকটি, যাকে সে দুলাভাই বলবে, বিলু আপাও কি তার নিচে অমনভাবে শোবে, আর লোকটি, আজিজ যেমন বলেছে, সেভাবে কাজ করবে? না, না, বিলু আপা অমন কাজ করতে দেবে না, বিলু আপা কখনো অমন ময়লায় পেট ভরে তুলবে না। কিন্তু বিলু আপাও যদি অমন করে, বাধ্য হয় অমন করতে? কিছু দিন আগে রাশেদ এক খালাতো বোনের বিয়েতে গিয়েছিলো, একটা অসভ্য লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে তার, লোকটাকে সে কিছুতেই দুলাভাই বলবে না, ডালিম গাছের নিচে লোকটা হ্যাঁজাক লাইট পাম্প করতে করতে রাশেদকে ফিসফিস করে বলেছিলো, বুঝলি তর আফারে এইভাবে। ঘেন্নায় লোকটার কাছ থেকে সরে গিয়েছিলো রাশেদ। আজিজ বলছে, বারেক স্যারের খুব বিপদ হতো, রাবুর মারও খুব বিপদ হতো, কিন্তু তারা খালাশ করে ফেলেছে ঢাকা গিয়ে, নইলে গ্রামের মানুষ তাদের ছাড়তো না। গ্রামের মানুষ একটা কিছু করবেই, তবে তাদের অসুবিধা হচ্ছে রাবুদের বাড়ির সাথে গ্রামের লোকদের কোনো সম্পর্কই নেই, আর বারেক স্যারও গ্রামের মানুষদের মূর্খ গাধা মনে করেন, তাদের সাথে কোনো কথাই বলেন না। কয়েক বছর আগে বারেক স্যার নাইনে বাঙলা পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন ধর্মটর্ম সব বাজেকথা, ওইগুলো মানুষই বানিয়ে আল্লা ভগবান ঈশ্বরের নামে চালিয়ে দিয়েছে; তাতে পণ্ডিতবাবু কোনো রাগ করেন নি, বলেছিলেন কে জানে কোনটা সত্য, কিন্তু ছোটো মৌলভি সাব, যিনি চিৎকার না করে কথা বলতে। পারতেন না, কথা বলার সময় যার মুখ থেকে থুতু ছিটকে পড়তো, ক্ষেপে তাকে মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে মারতে গিয়েছিলেন, পারেন নি ছাত্ররা বাধা দিয়েছিলো বলে। এবার স্যারকে তারা একটা শিক্ষা দেবে, কীভাবে দেবে সেটা মাতবররা বুঝে উঠছে না। তারা ডাকলে বারেক স্যার আসবেন না, তাদের মূর্খ বলে গালি দেবেন, এটা তারা জানে; কিন্তু তাকে শাস্তি দিতেই হবে।