হাসান বলে, রিকশা, বাদাম তুলি চলো।
রিকশাআলা জিজ্ঞেস করে, পাড়ায় যাইবেন, ছার?
হাসান বলে, হ্যাঁঁ।
রিকশাআলা বলে, তার চাইতে একটা ভাল জায়গা আছে, মাইয়াটাও নতুন গেরাম থিকা আসছে, আমি লইয়া যাইতে পারি, ছার।
হাসান বলে, না বাদামতলিই চলো।
রিকশাআলা রিকশা ঘুরিয়ে বাদামতলির দিকে চালাতে থাকে; কিছুক্ষণ পর হাসান রিকশা অলাকে বলে, রিকশা, থামো।
রিকশাআলা রিকশা থামিয়ে বলে, পাড়ায় যাইবেন না ছার?
হাসান রিকশা থেকে নামতে নামতে বলে, না।
রিকশাআলা বিস্মিত হয়ে বলে, আপনে পাগল নি, ছার?
হাসান বলে, শুধু আমিই পাগল নাই, দশ হাজার বছর ধরে আমার বংশের সবাই পাগল, আমার বাপ পাগল, দাদা পাগল, তার বাপ পাগল…
রিকশাঅল বলে, কন কি, ছার, এমন পাগলের বংশে আপনে হইছেন?
হাসান বলে, হ্যাঁ, আমি, পাগলের বংশের শেষ পাগল, তবে আমার পরও আরো পাগল আসবে, পাগলু ছাড়া পৃথিবী সুন্দর
রিকশাআলা ভীষণ বিস্মিত হয়ে বলে, আপনের বংশের নাম কি, ছার?
হাসান বলে, কবি, কিন্তু তুমি তা বুঝবে না।
রিকশাআলা বলে, বুঝুম না, কন কি ছার? আপনে হইলেন কবিয়াল, আমাগো গ্রামের দবিরদ্দি ফকিরও কবিয়াল, আপনের মতনই পাগল, বউ পোলাপান ফেইল্যা খালি একতারা লইয়া দ্যাশে দ্যাশে ঘুইর্যা বেরায়।
কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৪
হাসান হোটেলের দিকে হাঁটতে থাকে।
দূরে একটা দশতলা দালান যেনোনা হাস্যানের সাথে কথা বলতে চায়।
হাসান বলে, তুমি একটি অশ্রুবিন্দু; তুমি চোখে টলমল ক’রে কাঁপছে, তোমার বুকের গভীরে অজস্র দুঃখ।
তোমাকে আমি শিশিরের মত্যুে মুঠোতে ধরতে চাই।
তুমি প্রজাপতি, সরষে খেতে উড়ে যাও, দশতলা, তুমি কদম ডালে ফুটে ওঠো আষাঢ়ের তুমুল বৃষ্টিতে।
দশতলা, তুমি প্রজাপতি হয়ে হারিয়ে গেছো, তোমার প্রত্যেক তলায়, নিজেকে তুমি খুঁজে পাচ্ছো না, তুমি জানাে না তুমি খুঁজছাে কাকে।
হাসানের মনে হয় দালানটিকে সে মুঠোতে ক’রে হাঁটছে, আর দালানটি তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরঝর ঝ’রে পড়ছে ঝরনাধারার মতো।
হোটেলে ঢোকার সময় ম্যানেজার উঠে তাকে একটা মস্ত সালাম দেয়। হাসান থমকে দাঁড়ায়; কলেজটা ছেড়ে আসার পর এমন সালাম সে অনেক দিন পায় নি। তার বেশ ভালো লাগে, মানুষের মাঝেমধ্যে সালামটালাম পাওয়াও দরকার। তাহলে সেও মানুষ, সালাম পেয়ে তার ভালো লাগছে?
ম্যানেজার বলে, ছার, আপনে পারমিশন দিলে আপনের ঘরে আধঘণ্টা পর আমি একটু আসুম।
হাসান বলে, আমি কি কোনো অপরাধ করেছি?
ম্যানেজার বলে, কন কি, কন কি ছার, আপনে অপরাধ করবেন ক্যান? আমিই অপরাধ করছি, দুই একদিন আগেই আমার যাওনা উচিত আছিল।
আধঘণ্টা পর ম্যানেজার তার ঘরের দরোজায় বেশ জোরে কড়া নাড়ে। হাসান দরোজা খুলে তাকে চেয়ারে বসতে বলে, আধশোয়াভাবে সে বিছানায় বসে।
ম্যানেজার বলে, ছার, আপনের বিছানায় দেহি খালি বই আর বই, এত বইপত্র পইর্যা আপনে কী করেন?
হাসান বলে, পড়ি, বই প’ড়ে কিছুই করি না।
ম্যানেজার জিজ্ঞেস করে, চাকরিবাকরি করেন কই?
হাসান বলে, আগে একটা কলেজে পড়াতাম, এখন কিছু করি না।
ম্যানেজার বলে, সারাদিন বইয়া আমি খুডইয়া খুডাইয়া প্যাপার পরি, আইজ প্যাপারে একটা কবিতার নিচে আপনের নাম দেখলাম। আমার মনে লয় অই কবিতাডা আপনেই লেখছেন।
হোটেলের ম্যানেজােরও কবিতা পড়ে, কবিতা কি বিচিত্র পথ পেরিয়ে এখন সর্বত্রগামী হয়ে উঠেছে?
হাসান বলে, হ্যাঁ, আমিই লিখেছি।
ম্যানেজার বলে, তাইলে ত আপনে কবি।
হাসান বলে, এখনো কবি হই নি, তবে হতে চাই।
ম্যানেজার বলে, আমার কি ভাইগ্য, আমার হোটেলে একজন কবি ওঠছেন, আমি একজন কবির দেখা পাইলাম; বুড়া আইলে কইতে পারুম অই কবিরে আমি চিনি, আমার হোটেলে সে আছিল।
হাসান বলে, ততোদিন আপনি আমাকে ভুলে যাবেন।
ম্যানেজার এবার একটু চুপ ক’রে থাকে, হাসানের দিকে ভালো ক’রে তাকায়, এবং বলে, ছার, কবিরা তা মাইয়ালোক পছন্দ করে?
হাসান বলে, সবাই মেয়েলোক পছন্দ করে। ম্যানেজার বলে, হ, হ, সবাই করে, আমিও করি, রাইতে একবার মাইয়ালোক ছারা আমারও চলে না।
হাসান বলে, আপনার স্বাস্থ্য দেখে তো মনে হয় একবার কেনো, দু-তিনবারই আপনার দরকার। আপনার বউ কটি?
ম্যানেজার বলে, বউয়ের দরকার কি ছার, বউ ত একটাই আছে গ্যারামে, হে পোলাপান লইয়া থাকে, আমার মাইয়ালোক লাগে বউ লাগে না, বিনাপয়সায়ই আমি মাইয়ালোক পাই।
হাসান বলে, আপনাকে আমার মহাপুরুষ মনে হচ্ছে।
ম্যানেজার বলে, আমার হোটেলে ভাল ভাল মাইয়া আছে, রেটও বেশি না, ছার, পুলিশরেও ট্যাকাপিয়সা দেওয়া আছে, ডর নাই, আপনের কি লাগবো?
হাসান জিজ্ঞেস করে, কাগজে আমার কবিতাটি কি আপনি পড়েছেন?
ম্যানেজার হা হা ক’রে হাসে, ছার, একবার পরছি, তয় অই কবিতা বোঝানের কি আমার সাইধ্য আছে, তয় একটা কথা মনে হইল।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কথাটি কী?
ম্যানেজার বলে, কবিতাটায় মাইয়ালোকের দেহের কথা আছে, দুখের কথা আছে, লজ্জার জায়গার কথাও আছে, মনে হইল অনেক দিন আপনে মাইয়ালোকের লগে শোন নাই, কিন্তু শোআনের লিগা আপনের শরিল ফাইট্যা যাইতেছে।
হাসান বলে, ম্যানেজার সাহেব, আপনি কবিতা বেশ বোঝেন, ইউনিভার্সিটির প্রফেসরগুলোও এতোটা বোঝে না।
ম্যানেজার বলে, কি যে কান ছার, কি যে কন।