সন্ত রহমত আলি মাহমুদ বলে, আমি তো একটা বড়ো আর্টিকেল ছাপতে চাই আপনাদের প্রতিভা সম্বন্ধে, কিন্তু লেখাটা লিখবে কে?
সালেহ ফরিদউদ্দিন বলে, হাসান রশিদ লেখাটা লেখতে পারে বইল্যা আমার মনে হয়, গদ্য লেখায় হাসানের হাত আছে; ও আগেও আমাগো লইয়া লেখছিলো।
নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে হাসান, এবং খুবই বিব্রত বোধ করে।
সালেহ ফরিদউদ্দিন হাসানকে বলে, দোস, তুমি ত কবিতা লেখা ছাইরাই দিছো, চাইর বছর আগে তুমিই আমাগো লইয়া একটা প্ৰবন্ধ লিখছিলা, আমাগো কবি বলছিলা, তারপর থিকাই তা আমরা কবি, আবার আমাগো লইয়া একটা প্রবন্ধ লেখো, তুমি ক্রিটিক হইয়া যাও। আমাগো একজন ক্রিটিক দরকার।
হাসান বলে, না, না, সমালোচক হওয়ার আমার ইচ্ছে নেই, তোমাদের কবিতা নিয়ে আমি এখন লিখে উঠতে পারবো ব’লে মনে হচ্ছে না।
বিভূতিভূষণ মণ্ডল সিগারেটে টান দিতে দিতে জট ছাড়াতে ছাড়াতে একদলা থুতু ফেলতে ফেলতে চোখ বন্ধ ক’রে বলে, ল্যাখো ল্যাখো দোস্ত, আমাগো লইয়া ল্যাখো, আমাগো মইধ্যে তুমিই একটু-আধটু লেখাপড়া জানো, আমরা কোন গুমুত লিখতাছি তুমিই তা ভাল বোঝতে পারছো, তোমার চাইর বছর আগের প্রবন্ধটায়ই তা আমার নাম প্রথম ক্রিটিসিজম লিটারেচারে স্থান পায়, আমি সেই কথা ভুলি নাই। আর্টিকেলের ভিতরে নিজের নাম দেখতে আমার সুখ লাগে। আমাগো লইয়া ল্যাখো, আমি তোমার নামে একটা বই ডেডিকেট কইর্যা দিমু, একটা খানকিরে কথা দিছিলাম, তার বদলে তোমার নামেই ডেডিকেট করুম।
হাসান বলে, আমি ঠিক এখন লিখে উঠতে পারবো না, বিভূতি, গদ্য লেখার জন্যে আমি ঠিক প্রস্তুত নই।
কাদের আবদুল বলে, কেনো পারবেন না হাসান সাহেব? আপনি লিখুন, আমাদের কবিতা সম্পর্কে লিখে আপনিও ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন; কবিদের সঙ্গে থেকে অনেক ক্রিটিকও ইম্মরটাল হয়েছে।
হাসান এবার একটু উত্তেজিত হয়, এবং বলে, বন্ধুদের কবিতা সম্পর্কে কোনো কবির সমালোচনা লেখা ঠিক নয়, এটা আত্মহত্যা।
আহমেদ মোস্তফা হায়দার জিজ্ঞেস করে, কেনো ঠিক নয়?
হাসান বলে, বন্ধুদের কবিতা সম্পর্কে লিখলে নিজের ক্ষতি হয়।
আহমেদ মোস্তফা হায়দার বলে, কেনো ক্ষতি হয়?
হাসান বলে, দেখেন নি কেমন ক্ষতি হয়েছে, বুদ্ধদেব বসুর? তিনি বন্ধুদের নিয়ে লিখেছেন, আর বন্ধুরা মনে করেছেন তাঁরাই কবি, বুদ্ধদেব বসু কবি নন। নির্বোধ নির্বোধ বােকাসোজা জীবনানন্দও প্রবন্ধে কবিতা উদ্ধৃত ক’রে কবির নাম দেন নি, বলেছেন ‘এক আধুনিক কবি লিখেছেন’, ‘এক কবির কবিতায় পাই’ ধরনের কথা, বন্ধু কবির নামটি তিনি উল্লেখ করেন নি। বোকা বোকা লাগলেও জীবনানন্দ চালাক ছিলেন। বুদ্ধদেবের থেকে। কবি হয়ে কবিবন্ধুদের কবিতা আলোচনা করতে নেই, তাতে বন্ধুরা মনে করে তারাই কবি, আর মুর্খ পাঠকেরা ভুলে যায় যে আলোচকও কবি, গুরুত্বপূর্ণ কবি।
কাদের আবদুল বলে, আপনাকে খুব কৃপণ মনে হচ্ছে।
হাসান বলে, আপনারাও কিন্তু অন্যের কবিতা সম্পর্কে লেখেন না, দু-চার পংক্তি গদ্য লিখলে বন্ধুদের নাম নেন না, সেখানে হেল্ডার্লিন হাইনে র্যাঁবোর নাম নেন। আমিও এখন আপনাদের সম্পর্কে লিখতে পারবো না। আমি এখন কবি হ’তে চাই, সমালোচক নয়, কবি, শুধুই কবি।
আড্ডা ভাঙলে বিভূতিভূষণ মণ্ডল হাসানকে বলে, দোস্ত, যাইবা নি আমার লগে, বাদামতলির পাড়ায়, আমি ত সেইখানেই আছি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, পাড়ায় কী ক’রে তুমি থাকো?
বিভূতিভূষণ মণ্ডল বলে, কবির লিগা পাড়া আর নিজের বাড়ির তফাৎ কি? কবির আবার ঘরবাড়ি কি? কবি যেখানে থাকে, সেইটাই তার বাড়ি। আমার লগে লও, দেখবা মাইয়া তিনটা ভাল, আমারে বাপ ডাকে গুরু ডাকে, আবার বিছনায়ও শোয়, ট্যাকাপয়সা অরাই দ্যায়।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি এটা পারো কীভাবে, বিভূতি?
বিভূতি বলে, কবিগো সব পারতে হয়, হাসান, কবি হইলে সব পারতে হয়। কবি হইলে এমন মানুষ যার ফাঁসি হইয়া গেছে। বছরখানেক আমি গুলশানে একটা বিলাতফেরত মাইয়ালোকের লগে আছিলাম, তার গাড়িবাড়ি সব আছিল, সমাজতন্ত্র তার প্রিয় জিনিশ, কিন্তু তার লগে থাকতে আর ভাল লাগল না, এখন মালতিগো লগে আছি, অগোই আমার ভাল লাগে, এডুকেটেড মাইয়ালোকের লগে শুহিয়া আমি সুখ পাই না। এডুকেটেড মাইয়ালোকেরা কবিতা বোঝে না, বেশ্যারা তাগো থিকা কবিতা অনেক ভাল বোঝে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কতো দিন ওদের তোমার ভালো লাগবে?
বিভূতি বলে, তা জানি না, ভাল না লাগলে বাইর হইয়া পরুম, হাইকোর্টের মাজার ত আছেই, ওইখানে থাকতেও আমার খারাপ লাগবো না। হিজড়াগো লগেও আমি আছিলাম ছয় মাস, খারাপ লাগে নাই।
বিভূতি গাঁজাভরা সিগারেট টানতে টানতে দক্ষিণ দিকে-হাঁটতে থাকে।
হাসান একটি রিকশা নিয়ে তার হোটেলের দিকে রওনা হয়, কিছু দূর গিয়েই তার মনে হয় বিভূতির সাথে বাদামতলির পাড়ায় গেলেই আজ রাতে, সে সুখ পেতো, হোটেলে সে অগ্নিগিরির মতো শূন্যতায় পড়বে, পুড়তে থাকরে লেলিহান আগুনে। শূন্যতার আগুনকে সে ভয় পায়, কিন্তু সে-স্থির করতে পারে না হোটেলের শূন্যতার চ্যান অগ্নিগিরিতে যাবে, না বাদামতলির পূর্ণতার দিকে রিকশাটাকে ফেরাবে, ভেতরে ঢুকে পূর্ণতার ভিতর দিয়ে বিভূতিকে খুঁজবে। সে তো বাদামতলি কখনো যায় নি, কী করে সে খুঁজে পাবে বিভূতিকে?