কয়েক সপ্তাহ ধ’রে খুবই যন্ত্রণা দিচ্ছে বালিকাটি।
প্রথম দিনই হাসান বালিকাটিকে বলেছে, তুমি আর এসো না।
আঠারো বছরের ওই তীব্র সৌন্দর্য বলেছে, আমি আসবো।
হাসান বলেছে, জানো, আমার বয়স পঁয়তাল্লিশ? তোমার পিতার সমান।
বালিকা বলেছে, কবিদের কোনো বয়স নেই।
হাসান বলেছে, আমি কবিগুরু নই যে আমার বয়স নেই, আমার বয়স আছে। তুমি আসবে না, তোমাকে আমি পছন্দ করি না।
সৌন্দর্য বলেছে, আমি আসবো, আপনাকে আমি পছন্দ করি।
বালিকা আসছে, দিনের পর দিন, হাসান তাকে তাড়িয়ে দিতে পারছে না। আমি কি সত্যিই চাই বালিকা না আসুক? তাহলে আমি ওকে বাসার টেলিফোন নম্বরটিও কেনো দিলাম? যদি সত্যিই ওকে এড়াতে চাই, ও এলে ধমক দিয়ে কেনো বিদায় করি না, এটা তো আমি পারি, অভদ্র তো আমি হ’তে পারি অবলীলায়, কিন্তু কেনো পারি না; আর বাসায় ফিরে কেনো টেলিফোনের অসহ্য অমৃত ঝংকারের জন্যে ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত নিশ্বাসার্ত হয়ে থাকি? ওকে দেখলে কি ভেতরে কোনো গভীর স্মৃতি যন্ত্রণা হয়ে দেখা দেয়, ওর মুখে কি দেখতে পাই আমি অন্য কোনো মুখ? ওরা ওই বস্ত্রের ভেতরে কি আছে আমার চেনা এক অনির্বচনীয় অবিনশ্বর শরীর? কিন্তু না, ওকে বিদায় ক’রে দিতেই হবে; ওকে দেখে আমি সুখ পেতে চাই না।
বিকেলে অফিসে আসে ইয়াসমিন; দিগদিগন্তে, পশুকবলিত বাঙলার আকাশে আকাশে রঙ আলো সোনালি মেঘ ছড়িয়ে পড়ে।
হাসান শুরুতেই বলে, তোমাকে বলেছি তুমি আসবে না।
ইয়াসমিন বলে, সে তো পুরোনো কথা, নতুন কিছু বলুন।
হাসান বলে, তুমি জানো না কি ভয়ঙ্কর বিপদ তোমার জন্যে অপেক্ষা ক’রে আছে, তুমি জানো না বালিকা।
ইয়াসমিন বলে, আত্মহত্যা করতে হবে আমাকে?
হাসান বলে, তার থেকেও ভয়াবহ।
ইয়াসমিন বলে, সেটা হবে খুব সুন্দর।
হাসান বলে, সুন্দর দেখে দেখে তুমি অসুন্দর কাকে বলে জানো না।
ইয়াসমিন বলে, আপনার সাথে আমার কোনো নদীর পারে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে।
হাসান বলে, আমি নদী চিনি না।
ইয়াসমিন বলে, তাহলে চলুন আমি চিনিয়ে দেবো।
হাসান বলে, নদী আমি চিনতে চাই না।
ইয়াসমিন তার একগুচ্ছ সোনার আঙুল হাসানের দিকে বাড়িয়ে বলে, এগুলো একবার ছুঁয়ে দেখবেন? দেখুন তো এগুলো নদী কি না?
সোনার আঙুল ছোঁয়ার সুখ তার জন্যে নয়, তার জন্যে তীব্ৰ বিষ; হাসান উঠে টয়লেটে গিয়ে বসে থাকে, কমোডের ভেতরে তার লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।
বেরিয়ে বলে, তুমি যাও, তুমি আর আসবে না।
ইয়াসমিন আবার সোনার ঝিলিকগুলো তার দিকে ছড়িয়ে দেয়, বলে, ছুঁয়ে দেখুন, নদী ছুঁইয়ে দেখুন।
হাসান বলে, নদী আমার জন্যে নয়। তুমি যাও।
কিন্তু ইয়াসমিন আসে, এবং টেলিফোন করে; হাসান সুখ পায়, এবং গভীরতম নিঠুরতম যন্ত্রণা বোধ করে; না এলে বোধ করে অতল শূন্যতা, এলে তার ভেতর দাঁত বসায় যন্ত্রণা; টেলিফোন করলে নেকড়ে তার হৃৎপিণ্ড কামড়ে ছিঁড়ে নেয়, না করলে শূন্যতার শীতল তুষারপাতে সে লুপ্ত হয়ে যায়।
কিন্তু না; বিদায় ক’রে দিতে হবে ইয়াসমিনকে।
সেদিন সে বাসায় ফেরে। অনেক রাতে; ফিরেই শোনে টেলিফোন বাজছে। না, না, ধরবো না, হাসান কিছুক্ষণ ব’সে থাকে; তারপর ধরে।
ইয়াসমিন বলে, পৃথিবীর সব কাজ শেষ ক’রে অবশেষে ফিরলেন?
হাসান বলে, ফেরার ইচ্ছে ছিলো না।
ইয়াসমিন বলে, জানতেন আমি ফোন করবো, তবু দেরিতে ফিরলেন কেনো?
হাসান বলে, আমি কোনো শেকলে বাঁধা নই।
ইয়াসমিন বলে, আপনি এক গভীর অন্ধকার গর্তে প’ড়ে আছেন।
হাসান বলে, হ্যাঁ।
ইয়াসমিন বলে, আপনাকে আমি উদ্ধার করবো।
হাসান ব’লে ফেলে, কী দিয়ে?
ইয়াসমিন বলে, আমার হৃদয়, আমার প্রেম।
হাসান বলে, না, না, না।
হাসান টেলিফোন রেখে দেয়, টেলিফোন বাজতে থাকে অনন্ত যন্ত্রণার মতো।
হাসানের আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না, সে বেরিয়ে পড়ে। রাতটা কাটিয়ে দেবো আমি অন্ধ আতুর কুষ্ঠরোগী চোর পকেটমার বেশ্যা হিজড়ে সমস্ত দণ্ডিতদের সাথে, আমিও দণ্ডিত, আমিও তো হিজড়ে, কুষ্ঠরোগীদের থেকেও ঘূণ্য, অন্ধের থেকেও পতিত; হাসান হাঁটতে থাকে। পথের পাশে একবার বসে সে, ওই দিকে জটলা করছে অন্ধ আতুররা, তাদের পাশে গিয়ে বসবো, ঘুমিয়ে পড়বো? আমি তো কবি, অপুরুষ, সকলের সঙ্গী; ওদের সাথেই আমার সম্পর্ক, ওরাই আমার আত্মীয়, এই নরকবাসীরাই আমার বান্ধব। একবার সে ইটওঠা ময়লালাগা ফুটপাতে শুয়ে পড়ে; তার কষ্ট হয়, সে উঠে হাঁটতে থাকে, সারারাত হাঁটে। ভোরে তার ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হয়; ফিরেই শোনে বানবান ক’রে বাজছে ইয়াসমিন।
ইয়াসমিন বলে, আজ উঠেই আপনাকে শুনতে ইচ্ছে হলো।
হাসান বলে, আমাকে শোনার কিছু নেই।
ইয়াসমিন বলে, আপনার স্বর থেকে মধু ঝরে, আমি পান করি।
হাসান বলে, তুমি বিষকে মধু মনে করো।
ইয়াসমিন বলে, বিষই আমার কাছে মধু।
হাসান বলে, তুমি আর ফোন করবে না।
ইয়াসমিন বলে, আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, এখনি, এই ভোরবেলা।
হাসান বলে, তুমি বিকেলে আমার বাসায় এসো।
ইয়াসমিন উল্লাসে ফেটে পড়ে, বাসায় আসবো আমি? কখন? ঠিকানা কি?
হাসান ঠিকানা দেয়; কীভাবে আসতে হবে, কোন দোকানের উল্টো দিকে নামতে হবে, কী-তলায় উঠতে হবে, সব বর্ণনা করে বিস্তৃতভাবে।
বিকেলে চারপাশের সমস্ত আবর্জনাকে সোনায় পরিণত ক’রে ইয়াসমিন আসে।