হাসান বলে, আমি ভাই নই।
তারা বলে, কামারভাই তো ভাই বললে খুশি হন, তিনি বয়সে আপনার থেকেও বড়ো।
হাসান বলে, তার নামে আপনারা জয়ধ্বনি দিয়ে ধন্য হ’তে থাকুন।
তারা বলে, তিনি তাঁর কবিতার বই উপহার দেন আমাদের, তাঁর কবিতা সম্পর্কে লিখতে বলেন; কি চমৎকার মানুষ তিনি।
হাসান বলে, গৌণ কবিদের এসব করতেই হয়; আর চমৎকার কেনো, আমি তো মানুষই নই।
তারা বলে, আপনি বিস্ময়কর।
তরুণরা আর আসে না। কষ্ট লাগে হাসানের তরুণদের ও নিজের জন্যে; একটি গভীর চিৎকার সে অশ্রুর মতো বুকের ভেতরে জমিয়ে রাখে। তরুণদের তবু সহ্য হয়, ঘেন্না হয় ওই বুড়োগুলোকে। তারা আসে না, ফোন করে; হাসান ফোন রেখে দেয়, তারা আর ফোন করে না; হাসান সুখী বোধ করে।
আর আসে নারীরা, তরুণীরা।
কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ১৭
এক নারী, ঘন নিবিড়, তার সাথে দেখা করতে আসে, বলে, আপনাকে দেখতে চ’লে এলাম, আপনার কবিতা এতো ভালো লাগে, আমার প্রিয় কবি আপনি।
হাসান তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অ্যাড সংশোধন করতে থাকে।
নারী বলে, আমার দিকে আপনার তাকাতে ইচ্ছে করছে না?
হাসান বলে, না।
নারী বলে, আমি কি এতোই অসুন্দর?
হাসান বলে, আসার কোনো দরকার ছিলো না।
নারী স্তম্ভিত হয়ে বলে, শুনেছি কবিরা অনুরাগিণী পছন্দ করেন, রবীন্দ্রনাথ করতেন।
হাসান বলে, আমি করি না।
নারী বলে, আপনি বেশ অভদ্ৰ মনে হচ্ছে।
হাসান বলে, বেশ নয়, অতিশয়; আমার কবিতাও অভদ্র।
নারী বলে, আমি আপনার কবিতায় মুগ্ধ, আপনার অনুরাগিণী; আপনার কবিতা আপনার মতো অভদ্র নয়।
হাসান বলে, আপনি সম্ভবত কামঅতৃপ্ত।
নারী চমকে ওঠে, বলে, আপনি কী ক’রে বুঝলেন?
হাসান বলে, অনুরাগ জন্মে কামঅতৃপ্তি থেকে।
নারী বলে, হ্যাঁ, আমি অতৃপ্ত।
হাসান বলে, আমি পরিতৃপ্ত করতে পারবো না, দয়া ক’রে আপনি যান।
নারী বলে, আপনাকে দেহ দিতে আমি প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এখন আমি শুয়োরকেও দেহ দিতে পারি, আপনাকে না।
হাসান বলে, আমি শুয়োরেরও অধম।
ঘরে ফিরে এসে হাসান সারারাত ক্ষমা চাইতে থাকে ঘন নিবিড় নারীর কাছে; তার প্রতিটি অঙ্গের কাছে। আমাকে ক্ষমা ক’রে দাও নারী, ক্ষমা চাই আমি; তোমার যে স্তন আছে, ঠোঁট আছে, আছে এক অবর্ণনীয় স্বর্ণখনি, তাই ক্রুদ্ধ করেছে আমাকে; ওসব অপূর্ব হীরকখণ্ড আমার জন্যে নয়। স্তন, আমাকে ক্ষমা কোরো; ঠোঁট, আমাকে ক্ষমা কোরো; সোনার খনি, ক্ষমা কোরো আমাকে। কিন্তু এখনো নারী আছে কেনো? আমি চাই নারী না থাকুক পৃথিবীতে। আমাকে তুমি ক্ষমা কোরো, নারী, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই;– শুয়োরও তোমাকে সুখী করতে পারে; আমি, কবি, পারি না।
দু-তিনটি পুরস্কার পেয়েছে এর মাঝে হাসান, পথে পথে আজকাল পুরস্কার ছড়িয়ে পড়ছে, না চাইলেও পাখির মলের মতো মাথায় জামায় এসে পড়ে। না, না, না, ক’রে ক্লান্ত হয়ে শেষে সে একটি নিতে সম্মত হয়, এবং পুরস্কার নিতে যায়।
তার ভাষণে সে বলে, এসব পুরস্কার নিরর্থক, গৌণ কবিদেরই পুরস্কার প্রাপ্য, তাদের পুরস্কার দরকার, এসব পুরস্কার সারাক্ষণ বলে তুমি যে কবিতা লিখতে ব্যর্থ হয়েছে তার সান্ত্বনা হিশেবে পাচ্ছো পুরস্কার। তোমার কবিতা হয় নি, পুরস্কারও যদি না পাও, তাহলে তুমি বাঁচবে কী নিয়ে? আজ পুরস্কার নিয়ে বুঝতে পারছি আজো আমি গৌণ কবিই রয়ে গেছি।
চারদিকে একটা হাহাকার ওঠে, সে শুনতে পায়।
প্রশ্নোত্তরপর্বে একজন জিজ্ঞেস করে, আপনি কবি কামর আবদিনের মতো জনগণের কথা বলেন না কেনো?
হাসান বলে, ভেতরে কবিতা না থাকলে জনগণের কথাই বেশি বলতে হয়, জনগণ সাধারণত নির্বোধ, রাজনীতিবিদেরা তাদের প্রতারণা করে, এ-কবিরাও প্রতারণা করে তাদের; জনগণের কথা বলা কবিতা নয়, কবিতা হচ্ছে কবিতা।
আরেকজন প্রশ্ন করে, আপনি কি মানুষকে ভালোবাসেন?
হাসান দ্বিধাহীনভাবে বলে, না।
সে জিজ্ঞেস করে, ঘৃণা করেন?
হাসান দ্বিধাহীনভাবে বলে, হ্যাঁ।
আরেকজন জিজ্ঞেস করে, আপনি নারী ভালোবাসেন?
হাসান দ্বিধাহীনভাবে বলে, না।
একজন প্রশ্ন করে, তাহলে আপনি কবিতা লেখেন কেনো?
হাসান বলে, নিরর্থকতাকে তাৎপর্যপূর্ণ করার এটা আমার ব্যর্থ চেষ্টা।
একজন প্রশ্ন করে, মনে হচ্ছে আপনি রেগে আছেন, কিন্তু আপনার কবিতা তো এমন রাগের কবিতা নয়, তা তো গভীর যন্ত্রণার।
হাসান চুপ ক’রে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে–দীর্ঘ সময় ধ’রে, নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে চারদিক, তার মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত প্ৰান্ত থেকে মাটির ভেতর দিয়ে প্রবল রোদনের স্রোত বয়ে আসছে, ঢুকছে তার ভেতরে; তার চিৎকার ক’রে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে।
সে শুধু বলে, আমি আর কথা বলতে চাই না, আমার কোনো কথা নেই।
হাসান মাইক্রোফোন থেকে আর তার আসনে ফিরে যায় না।
সে মঞ্চ থেকে নামে, চারদিকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, তাকে ঘিরে অনুরাগীরা দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, স্বাক্ষরের জন্যে খাতা বাড়িয়ে ধরে; সে এই সব পেরিয়ে রাস্তায় এসে পৌঁছে, অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকে।
রাতে ঘরে ফিরে এসে হাসান মেঝের ওপর স্তব্ধ হয়ে বসে। হাসান, নিজের সাথে কথা বলতে থাকে সে, তুমি কেনো এতো ঘৃণা করছে নিজেকে, এবং ঘৃণায় ঢেকে ফেলছো। গাছপালা মেঘ সমুদ্র মাটি শিশির পাখি পুষ্প মানুষ? শুধু সম্পর্ক পাতাতে পারছো না ব’লে, শুধু তোমার শরীরটিকে ব্যবহার ক’রে সুখ সৃষ্টি করতে পারছে না ব’লে? হ্যাঁ, তাই, হ্যাঁ, তাই; মানুষ আমাকে ছিন্ন করেছে, প্রকৃতি যদি অন্ধ বধির ; বিকলাঙ্গ বৃক্কহীন ভগ্নহৃৎপিণ্ড অপুরুষ করতো আমাকে মেনে নিতাম; কিন্তু মানুষ, হিংস্র৷ মানুষ আমাকে ছিন্ন করেছে, ভয়াবহ মানুষ ছিন্ন করেছে আমাকে মানুষের সাথে সম্পর্ক থেকেই, তাকে ঘৃণা ক’রে যেতে হবে। ঘৃণা ক’রে যেতে হবে। প্রেমে নয়, ঘৃণায়ই বেঁচে থাকতে হবে; সুখে নয়। বাঁচতে হবে অনন্ত যন্ত্রণায়। শিল্পকলা আর সুখ নয়। আমার জন্যে, শিল্পকলা এক অপার যন্ত্রণা, কিন্তু তাকে নিয়ে আমি বঁচবো। শিল্পকলা যার দয়িতা, সে কবে সুখ পেয়েছে? আমিও পাবো না; কিন্তু থাকতে হবে সৃষ্টিশীল। হাসান তার ছিন্ন শিশ্নমূলের দিকে তাকায়, হো হো হাসে, বলে, আমি ভেবেছিলাম তুমিই শিল্পের সম্রাট, তোমার থেকেই উৎসারিত হয় কবিতা; কিন্তু তোমাকে ছাড়াও আমি লিখছি কবিতা। হো হো হো, প্রিয়, তোমাকে ছাড়াই যদি পারি, তাহলে কেনো পারবো না ওই হিংস্র মানুষ ছাড়া?