আলাউদ্দিন বলে, করুম ক্যামনে, একটা বউ আছে না?
হাসান বলে, ডিভোর্স করো।
আলাউদ্দিন বলে, না, না, ডিভোর্স করতে আমি পারুম না, পোলাপান আছে। বউটার লগে শুই না, তয় ডিভোর্সও করতে পারুম না।
হাসান বলে, আলাউদ্দিন, আমি চাকুরিটা ছেড়ে দিতে চাই।
আলাউদ্দিন বলে, না, দোস্ত, এইটা করবা না; তোমার লিগাই অ্যাডটা ভাল চলতাছে। তোমার ব্যাতন বারাই দিমু, পায়ে ধরাতাছি। তুমি আমারে ছারবা না।
হাসান বলে, আর অ্যাড ভালো লাগে না।
আলাউদ্দিন বলে, তাইলে করবা কি? হাসান বলে, কবিতা লিখবো, কবিতা লিখেই জীবনটা কাটিয়ে দেবো। আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, কবিতা লেইখ্যা কি হুইস্কি খাইতে পারবা, গাড়ি চরতে পারবা, আর ওই পদ্মফুলের মতন সুন্দরীটারে পালতে পারবা?
হাসান বলে, এর কিছুই আমার লাগবে না।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, মনে হইতাছে তুমি আমার থিকাও গোলমালে আছো, চাকরি ছারার তোমার দরকার নাই।
হাসান বলে, ভেবে দেখি।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, অফিসে থাইক্যো, সন্ধ্যার পর আসন্তাছি। অনেক দিন এক লগে ড্রিংক করি নাই।
সন্ধ্যার পর আলাউদ্দিন আসে; তাকে দেখেই চিৎকার ক’রে ওঠে, দোস্ত, হইছে। কি তোমার, শুখাই গ্যাছো।
হাসান বলে, বেশ তো আছি।
আলাউদ্দিন প্রচুর খাচ্ছে আর পান করছে, আর কথা বলছে; হাসানের সবই নিরর্থক মনে হয়। প্যাট, বউ, পোলাপান, ডিভোর্স, সমাজ, এমআর মানসম্মান, শোয়া প্রভৃতি শব্দ, যা আলাউদ্দিন উচ্চারণ ক’রে চলছে। অনবরত, এবং সেগুলোকে জড়িয়ে দিচ্ছে যে-সব শব্দের সাথে, তার কোনোটিকেই অর্থপূর্ণ মনে হয় না হাসানের; সে শুধু মনে মনে বলতে থাকে- নিরর্থক, সবই তাৎপর্যহীন, এসব আমার কাছে কোনো অর্থ প্রকাশ করে না। নিরর্থকতা মানুষ কতোক্ষণ সহ্য করতে পারে? যে-মেয়েটি ওই দিকে দাঁড়িয়ে আছে, সে নিরর্থক; যে-পানপত্র ঝলমল করছে তার সামনে, সেটি নিরর্থক; ওইদিকে সারিসারি খাবার, নিরর্থক। কতোক্ষণ আমি সহ্য করতে পারি এই নিরর্থকতা? নিরর্থকতা আমাকে আক্রমণ ক’রে চলছে চারদিক থেকে, এই পানিপাত্র আক্রমণ করছে আমাকে, খাদ্য রাশি আক্রমণ করছে আমাকে, এইসব মানুষেরা আক্রমণ করছে আমাকে; আমাকে মুক্তি পেতে হবে এর থেকে। হাসান টয়লেটে যাবে ব’লে বেরোয়, বেরিয়ে বারান্দার দিকে যায়; একটি লিফটু ওপরে উঠবে ব’লে হা ক’রে অপেক্ষা করছে, হাসান লিফটে উঠে পড়ে। উচ্চতম তলায় এসে লিফটু থেকে সে নামে; বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে ছাদে ওঠার সিঁড়িটি দেখতে পায়, ধীরে ধীরে সে ছাদে ওঠে। ছাদে উঠে চারদিকে আলোকিত নিরর্থকতা দেখে সে অনুপ্রাণিত বোধ করে;–এটাই শ্ৰেষ্ঠ সময়, আমি নিরর্থকতা থেকে মুক্তি পেতে পারি শুধু ছাদ থেকে লাফ দিয়ে। মেঘা, মেঘা, আমার আত্মা; শিশ্ন, শিশ্ন, আমার সম্রাট।
লাফ দিতে গিয়ে হাসান নিজেকে টেনে ধরে।
আমি কবি, আমি দণ্ডিত, আমি অপুরুষ। লাফ দেয়া কোনো সমাধান নয়।
আমাকে বইতে হবে মানুষের সমস্ত দুর্ভাগ্য।
হাসান বলে, মেঘা, আমি নামছি।
টেবিলে গিয়ে দেখে আলাউদ্দিন কাৎ হয়ে আছে, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আলাউদ্দিনও হয়তো আক্রান্ত হয়েছে কোনো নিরর্থকতা দিয়ে।
মধ্যরাতে হাসান নিজের ঘরে ফিরে মেঘার দেয়া ডায়রির প্রথম পাতায় লিখতে থাকে একচল্লিশ, অপুরুষ, দণ্ডিত, কবি; কবিতা ছাড়া আর কিছু নেই; যা কিছু লিখেছি আর আমি কখনো খুলে দেখবো না, সেগুলো নিশ্চয়ই তুচ্ছ, জরাগ্রস্ত, যতো দিন আছি লিখতে চেষ্টা করবো অজর কবিতা, হয়তো দশটি কি বিশটির বেশি লিখতে পারবো না, অজস্র জরাগ্রস্ত কবিতা নয় দশটি কি বিশটি অজর কবিতা। কবিতা ছাড়া আর কারো সাথে সম্পর্ক নয়; অপুরুষের একটিই সম্পর্ক সকলের সাথে— সম্পর্কহীনতা; থাকতে হবে সম্পর্কহীনতার সম্পর্কে, কামনাহীন কামনায়, বিমানবিক মানবিকতায়; দেয়াল থাকবে চারদিকে, দেয়াল ভেদ ক’রে ঢুকবে না কোনো কোনো কাতরতা কোনো মানুষ। লিখতে লিখতে, আশ্চর্য, একরাশ পংক্তি, একরাশ চিত্রকল্প জড়ো হ’তে থাকে তার মাথার ভেতরে, জমাট হয় রক্তের মতো; পংক্তিগুলোকে চিত্রগুলোকে হাসান ছন্দে দুলিয়ে দেয়, একটি কবিতা তার সামনে পুকুরে রক্তপদ্মের মতো স্থির হয়ে ভাসতে থাকে।
চারটি বছর কেটে যায় : কবিতায়, নিঃসঙ্গতায়, সম্পর্কহীনতায়।
এই যে আমি আছি একলা, সাড়া দিচ্ছি না। কারো ডাকে, ডাকাছি না কাউকে, ফিরিয়ে দিচ্ছি। সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে, বই দিয়ে ঘিরে ফেলছি আমাকে-একেই কি বলে ধ্যান? হো হো হো হো হাসে হাসান। ধ্যান কাকে বলে? এটা ধ্যান নয়, এটা হচ্ছে বিশ্বকে নিজের ভেতরে ছোট্ট সোনার বলের মতো সংহত করা; কবিতায় আমি তাই করছি, করতে চাই। আমি গৃহীত হচ্ছি? আমার কবিতা আকৃষ্ট করছে অনুরাগীদের? পুরস্কার পুরস্কার পাচ্ছি? সবই তুচ্ছ, নিরর্থক; কিছুই মূল্যবান নয়।
কিছু কিছু তরুণ কবি মাঝেমাঝে দেখা করতে আসে।
বলে, আপনাকে দেখতে এলাম।
হাসান বলে, কেনো?
তারা বলে, আপনি আমাদের প্রিয় কবি, আপনার কবিতা অন্য রকম, আমাদের নাড়া দিচ্ছে, আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হলো, তাই এলাম।
হাসান বলে, প্রিয় কবিকে যারা দেখতে আসে, তারা কখনো কবি হবে না।
তারা বলে, আমরা কবি হবো না?
হাসান বলে, না।
তারা বলে, কামর আবদিন ভাইয়ের কাছে গেলে তিনি খুব খুশি হন, আমাদের চাবিস্কুট খাওয়ান, বলেন, আপনারা আবার আসবেন।