বেশ আলো ঢুকছে তার চোখে, তার মগজে; সে তার ঘরটি দেখতে পায়। এটা আমার ঘর, আমি এখানে ঘুমোই, আমি এখানে ঘুমিয়ে ছিলাম, এখানে আমি ঘুমিয়ে থাকবো। আমাকে উঠতে হবে। হাসান ওঠার চেষ্টা করে, দেখে তার ডান হাতটি দুই উরুর মাঝখানে কী যেনো চেপে ধ’রে আছে। হাত, আমার হাত, তুমি কী চেপে ধ’রে আছো? তোমার মুঠোয় কী অপূর্ব সম্পদ? হাসান হাতটি সরিয়ে নেয়; দেখতে পায় সেখানে ফুটে আছে লাল টকটকে একটা রক্তগোলাপ। রক্তগোলাপ আমার দুই উরুর মাঝখানে? আমি কি গান গেয়ে গেয়ে ফুটিয়েছি। এই গোলাপ? একটু নড়তেই রক্তগোলাপী খসে পড়ে; হাসানের চোখে পড়ে শূন্যতা সে একবার হেসে উঠতে চায়। ওহ, তুমি নেই, ওহ, তুমি নেই? তোমাকে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে দানবেরা? হো হো ক’রে হাসার চেষ্টা করে হাসান; কিন্তু সে হাসতে পারে না, তার কান্না পায়; গভীর গভীর থেকে বিপুল কান্না জলধারার মতো বেরিয়ে আসে তার চোখ দিয়ে। আমি কাঁদছি কেনো? জানি না। আমি কাঁদছি কেনো। অনেক বছর আমি কাঁদি নি, এখন আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে কেনো? নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে হাসান; কান্নার থেকে আর কোনো সুখ নেই।
এখানে কী ছিলো? এখানে কে ছিলো? মনে পড়তে চায় না হাসানের, তারপরই মহাস্মৃতির মতো মনে পড়ে; যে-মহান অধীশ্বর ছিলো এখানে, যে এখন নেই, তার মুখ দেখতে পায় হাসান- তুমি নেই, আমার শিশ্ন, হে অধীশ্বর, আমার সত্তা, তুমি নিহত, তুমি শহিদ? তুমি নেই, সম্রাট, রাজাধিরাজ, মহাবীর, হে প্রতিভাবান মহাকবি, তুমি নেই; আমার গৌরব, আমার প্রেরণা, তুমি নেই, তুমি অন্যায় সমরে নিহত। দেখতে পাচ্ছি আমি তোমার রাজাধিরাজ মুখমণ্ডল: তুমি সেই ছোট্ট কুমার স্বপ্নটি ছিলে, তারপর তুমি হয়ে উঠেছিলো যে-কোনো রাজার থেকে মহিমান্বিত, তোমার মস্তকে জ্বলজ্বল করতো সূর্য, সূর্যের মুকুট প’রে তুমি আমাকে দিয়েছে সাম্রাজ্য। জয়ের আস্বাদ, তুমি নেই, সত্তা আমার। তোমার বলবান অশেষ দৃঢ়তায় কতোবার মুগ্ধ হয়েছি, তোমার সঙ্গীতে মুখর হয়েছে অরণ্য, নেচে উঠেছে অজস্র ঝরনাধারা; তোমাকে মুঠোতে নিয়ে খেলেছে আমার প্রেম, মুখগহবরে গ্রহণ ক’রে ধন্য হয়েছে আমার সাম্রাজ্য, তুমি গভীর গভীর অনন্ত আলোতে অনন্ত অন্ধকারে প্রবেশ করেছে, মধুতে প্লাবিত করেছে। বিশ্ব, আমার রাজাধিরাজ; তুমি বাজ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছো গ’লে গেছো বসন্তের বনভূমি হয়ে, তোমার স্পর্শে মুকুলিত হতো নানা তরুবর গগনে গগনে লাগতো ডালপালা। তুমি নেই, আমি কি আছি? তুমি ছিলে আমার সর্বস্বের উৎস, কবিতার জীবনের স্বপ্নের, তোমার প্রেরণায় শব্দ হয়ে উঠতো কবিতা, বেঁচে থাকা হয়ে উঠতো জীবন, জীবন হয়ে উঠতো স্বপ্ন, তোমাকে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে দানবেরা, ছিঁড়ে নিয়ে গেছে আমাকেই।
রক্ত বন্ধ হয়ে গেছে? কী ক’রে বন্ধ হলো? আমার শরীরে রক্ত এতো কম? সব রক্ত কেনো প্রবল বেগে বেরিয়ে শূন্য করলো না আমার হৃৎপিণ্ডকে? হৃৎপিণ্ড, তুমি আর কেনো সঞ্চালন ক’রে চলছো রক্ত? তুমি নিঃশেষ ক’রে দাও সব রক্ত, সব রক্ত ঝ’রে পভুক এই ছিন্ন শিশ্নমূল দিয়ে; ভাসিয়ে দিক নগরের পর নগর রাজধানির পর রাজধানি; প্লাবিত ক’রে দিকে গ্ৰহনক্ষত্রমণ্ডল।
হাসান ওঠার চেষ্টা করে, উঠতে কষ্ট হয়; কিন্তু ধীরেধীরে উঠে দাঁড়ায়।
আমি কী এখন? দণ্ডিত? অপুরুষ? আমি আর পুরুষ নই? আমি নারী নই? আমি কবি? হ্যাঁ, আমি কবি, আমি কবি; কবির পুরুষ হওয়ার দরকার নেই, নারী হওয়ার দরকার নেই। কবিকে হ’তে হবে অপুরুষ: আমি অপুরুষ, আমি কবি।
কে যেনো আমার অন্তরতম ছিলো? ছিলো কেউ? হ্যাঁ, ছিলো। মেঘা? মেঘা কোথায়? সে কি এখনো ফেরে নি? বাসায় গিয়েছিলো মেঘা, শিগগির ফিরবে ব’লে, এখনো ফেরে নি? কেনো ফেরে নি? না ফিরেই পারে না। তাহলে সে কই? মেঘা ফেরে নি; টেলিফোন করেছে সে? করেছিলো? করে নি?
হাসান ডাকে, মেঘা, মেঘা, মেঘা ৷
মেঘা নেই; থাকলে এমন শূন্যতা থাকতো না।
মেঘাকে কি আমি টেলিফোনে পেতে পারি? কতো নম্বর? কতো নম্বর যেনো? আমার মগজে ছিলো, সেটি মুছে গেছে মনে হচ্ছে।
হাসান ফোন করতে বসে, বলে, মগজ আমাকে সাহায্য কোরো, যা মুছে গেছে তাকে আবার সোনার অক্ষরে লেখে; মগজ, তুমি শেষবারের মতো দয়া করো।
ওই দিকে ঘণ্টা বাজছে, বাজছে, বাজছে।
এক সময় একটি মিীয়মাণ কণ্ঠ বলে, হ্যাঁলো।
হাসান বলে, হাসান বলছি, আমি মেঘাকে চাই।
ওইপাশে কণ্ঠ কান্নায় ভেঙে পড়ে, মেঘাদি নেই, মেঘাদি নেই, মেঘাদি নেই।
হাসান বলে, না, মেঘা আছে।
মেঘাদি নেই, আপনি আছেন?
হাসান বলে, আছি, না থাকলেই ভালো হতো।
কণ্ঠ হাহাকার ক’রে ওঠে, মেঘাদি নেই, আপনিও নেই, কেউ নেই, কেউ নেই, কেউ নেই।
স্তব্ধতা নামে মহাজগতে; হাসানের মনে হয় এই স্তব্ধতাই চেয়েছিলো সে। এই স্তব্ধতা মেঘা নেই তার স্তব্ধতা, এই স্তব্ধতা আমি নেই তার স্তব্ধতা, এই স্তব্ধতা রাজাধিরাজ্য নেই তার স্তব্ধতা।
এই স্তব্ধতা চেয়েছিলাম। আমি?
মেঘা নেই, এতে কি সুখ পাচ্ছি। আমি?
পাচ্ছি, মনে হয় পাচ্ছি।
মেঘা থাকলেই অসুখ আমাকে আক্রমণ করতো। সুখ পাচ্ছি- মেঘা নেই।
আমরা, মেঘা আর আমি, জড়িয়ে ছিলাম। কার বাধনে? কে বেঁধে রেখেছিলো আমাদের অচ্ছেদ্য বন্ধনে? আমাদের মধুময়, অমৃতের উৎস, ঠোঁট বাঁধতে পারতো। আমাদের? ঠোঁটের এতোটা শক্তি আছে? বাঁধতে পারতো আমাদের চুল, চোখ, আঙুল? চুল, চোখ, আঙুলের এতোটা প্রতিভা আছে? বাহু দিয়ে আমরা জড়িয়ে ধরেছি নিজেদের, জড়িয়ে থাকতে চেয়েছি অনন্তকাল, কিন্তু বাহু কি বাধতে পারতো আমাদের? বাহুর সেই শক্তি কই? প্রতিভা কই? আর হৃদয়, সেই মহান কিংবদন্তি, বাঁধতে পারতো। আমাদের? যদি না থাকতো উদ্ধত অপরাজেয় অক্লান্ত রাজাধিরাজ, যদি না থাকতো প্রতিভাবান মহাকবি, তাহলে মেঘা কি এসে উঠতো এই ঘরে, তাহলে মেঘা কি ছুটে আসতো আমার ডাকে, মেঘা কি ফুটতো ফুলের মতো বইতো নদীর মতো ঝরতো। বৃষ্টির মতো গলতো এঁটেল কাদার মতো? কে আমাদের গলিত সুগন্ধি কাদার ভেতরে গড়িয়েছে সূর্যের পর সূর্য চাঁদের পর চাঁদ? কে মেঘার অলিখিত শরীরে লিখতে পারতো। অনির্বচনীয় কাব্য–শব্দের পর শব্দ, উপমার পর উপমা, রূপকের পর রূপক, চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্প, বাক্যের পর বাক্য? ঠোঁট আমাদের বাঁধে নি, বাহু আমাদের বাঁধে নি, মহান কিংবদন্তির পূজনীয় হৃদয় আমাদের বাঁধে নি, তাদের সেই প্রতিভা নেই; আমাদের বেঁধেছিলো অজর রাজাধিরাজ আর বিগলিত সম্রাজ্ঞী; এখন রাজাধিরাজ নেই, তাই মেঘা নেই।