হাসান বলে, পাঁচ ঝুড়ি দশ ঝুড়ি, যা পারেন।
লোকটি বলে, সন্ধ্যার আগেই দিয়া যামু ছার।
লোকটি চ’লে গেলে মেঘা জিজ্ঞেস করে, এতো ফুলপাতা দিয়ে কী হবে?
হাসান বলে, শয্যা।
মেঘা বলে, পাতা আর ফুলের শয্যা?
হাসান বলে, পুরোনো ভারতে ফিরে যাবো আজ রাতে।
মেঘা বলে, আমি আরো অতীতে ফিরে যেতে চাই।
সন্ধ্যার পর যখন আকাশে চাঁদ উঠেছে, বনের প্রতিটি পাতায় যখন আটকে আছে ডজন ডজন চাঁদ, পাতার ফুলের শয্যায় তখন খেলা শুরু হয় চিতাবাঘ ও হরিণীর। পাতা আর ফুলের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে তাদের শরীর, পাতার ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে তাদের হৃদয়। তারা ক্লান্ত ও অক্লান্ত, তারা অবসাদগ্ৰস্ত ও চিরসজীব, তারা জীবিত ও তারা মৃত।
যখন রাত শেষ হয়ে এসেছে হাসান জিজ্ঞেস করে, তোমার এই বুকে কি কখনো অন্য কেউ ঘুমোবে, মেঘা?
মেঘা বলে, যেখানে একদিন হরিণ ঘুমিয়েছে সেখানে কখনো কোনো শুয়োরের স্থান হবে না।
হাসান বলে, আমি ওখানে চিরকাল ঘুমোতে চাই।
মেঘা বলে, আমি চিরকাল বুকে নিয়ে জেগে থাকতে চাই।
তিনটি দিন তিন মিনিটের মতো কেটে যায় রোগ, জ্যোৎস্না, ছায়া, অন্ধকারে; নখের দাঁতের রক্তিম ক্রিয়াকলাপে; চুম্বনে, চুম্বনে, সঙ্গমে, সঙ্গমে। শরীর সমস্ত মধু ঢেলে দেয় জঙ্গলের প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি লোমকূপ চুইয়ে নিরন্তর ঝরতে থাকে চাক ভাঙা মধু; তাদের শরীর গ’লে মধু হয়ে ভোরবেলায় টলমল করতে থাকে সবুজ ঘাসের শিখায়, কচুপাতার মসৃণ করতলে; তাদের আলিঙ্গন, চুম্বন, সঙ্গমের দাগ লেগে থাকে গাছের ওপরের গোলগাল চাঁদের শুভ্ৰ শয্যায়; জ্যোৎস্নাবিহ্বল হয়ে সেটি গ’লে পড়তে থাকে শালের পাতায় পাতায়। মধু ঝরতে থাকে শালের পাতা থেকে, পাখিরা মধু পান ক’রে মুখর ক’রে রাখে বনভূমি; গুঞ্জনে মেতে ওঠে মৌমাছিরা, ফুলে ফুলে এতো মধু তারা আগে কখনো পায় নি।
কেটে গেছে কতো দিন? এক মাস? দেড় মাস? না কি মহাকাল?
একদিন বিকেলে মেঘা অফিসে এসে বলে, একটি চমৎকার সংবাদ আছে।
হাসান হেসে বলে, শুধু চমৎকার তার বেশি নয়?
মেঘা বলে, শ্রেষ্ঠতম সংবাদ।
হাসান জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীতে কি নতুন কোনো পণ্য আসছে?
মেঘা বলে, পণ্যের থেকে অনেক বড়ো, স্বপ্ন।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কী সেই স্বপ্ন?
মেঘা বলে, আমার ভেতরে এক নতুন কবি জন্ম নিচ্ছেন, কবিতা লিখছেন।
হাসান বলে, কবিগুরু এসে গেছেন? নোবেল প্ৰাইজের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন?
মেঘা বলে, হ্যাঁ, গীতাঞ্জলি অনুবাদ করছেন মনে হয়।
হাসান বলে, চলো, আজ প্রচুর খাবো, কবিকে এখন থেকেই প্রচুর খাওয়ানো দরকার, দেশে সুস্থ কবি চাই।
মেঘা বলে, তারপর?
হাসান বলে, তারপর আমাদের বাসায় ফিরবো।
মেঘা বলে, আমাদের?
হাসান বলে, হ্যাঁ।
বাসায় ফিরে তারা অরণ্যে আদিম হয়ে চায়ের পেয়ালা হাতে মেঝেতে বসে, রক্তিম চা, টলমল করতে থাকে তাদের শরীরের মতো।
হাসান মেঘাকে বলে, বাসায় ফোন ক’রে দাও তুমি এখানে থাকবে।
মেঝেতে গড়াতে গড়াতে মেঘা জিজ্ঞেস করে, কী বলবো?
হাসান তার ওপরে গড়িয়ে পড়ে বলে, বলবে তুমি এখানে আছো, এখানে থাকবে।
মেঘা বলে, বাসায় একটা হৈচৈ পড়ে যাবে না?
হাসান বলে, সব মহৎ ঘটনা শুরু হয় হৈচৈ দিয়ে, সব ঐতিহাসিক ঘটনা মূলত হৈ চৈ, আজো তা হবে।
মেঘা বাসায় ফোন ক’রে বলে, আম্মা।
মেঘার আম্মা বলেন, রাইত বারোটা বাজে, তুই যে এখনও আসলি না, চিন্তায় চিন্তায় আমরা পাগল হইয়া আছি।
মেঘা বলে, আম্মা, আমি আজ আসবো না।
আম্মা বলেন, ক্যান আসবি না?
মেঘা বলে, আমি এখানেই থাকবো, আম্মা।
আম্মা জিজ্ঞেস করেন, কই থাকিবি তুই?
মেঘা বলে, আমার বাসায়, আম্মা।
আম্মা বলেন, তর বাসা কই? তর বাসা ত এইটা।
মেঘা বলে, না, আমি যেখানে আছি সেটা আমার বাসা, আম্মা।
আম্মা রেগে ওঠেন, তুই কি আমাগো না জানাইয়া বিয়া করছিস?
মেঘা বলে, না, আম্মা।
আম্মা বলেন, তুই কোনখানে আছস, ঠিকানা দে।
মেঘা বলে, কাল সকালে এসে আমি সব বলবো, আম্মা।
পরদিন মেঘার সাথে তাদের বাসার সামনের সড়ক পর্যন্ত যায় হাসান; সে নেমে অ্যাডে যায়, মেঘা চলে যায় তাদের বাসায়।
দুপুরেই মেঘার আব্বা ফোন করেন অফিসে, আমি মেঘার আব্বা।
হাসান বলে, আপনার সাথে দেখা করতে যাবো ব’লে আমি ভাবছিলাম।
মেঘার আব্বা বলেন, আমরাই আজ। আপনার সাথে দেখা করতে আসতে চাইতেছি।
হাসান বলে, কখন আসবেন?
মেঘার আব্বা বলেন, আপনেই সময় দেন।
হাসান বলে, সন্ধ্যার পর আমার বাসায় আসুন।
সন্ধ্যার পর মেঘা, তার আব্বা, একটি ছোটো বোন, এবং শক্তিশালী একটি পুরুষ আসে হাসানের বাসায়।
মেঘা হাসানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় সবাইকে।
মেঘার ছোটো বোনটি বলে, আপনার ঘরটি এতো সুন্দর!
হাসান বলে, তোমার ভালো লাগছে?
শক্তিশালী পুরুষটি, মেঘার মেজো চাচা, বলে, আমরা আসছি মেঘার লগে তোমার বিয়ার তারিক ঠিক করতে।
হাসান বলে, বেশ ভালো করেছেন।
শক্তিশালী পুরুষটি বলে, তারিখটা ঠিক করন দরকার।
হাসান বলে, আমি তো বিয়েতে বিশ্বাস করি না।
শক্তিশালী পুরুষটি বলে, বিয়াতে তুমি বিশ্বাস কর না, কিন্তু মাইয়াটারে ত প্র্যাগন্যাণ্ট কইর্যা ছারছো।
মেঘা চিৎকার ক’রে ওঠে, চাচা।
হাসান বলে, মেঘা আমার সাথে থাকবে।
মেঘার আব্বা বলেন, বিয়ে ছাড়া কি ক’রে থাকবো?
হাসান বলে, আমরা ভালোবাসি, মেঘা এখানেই থাকবে।