যখন ঘুম ভাঙে তখন অনেক বেলা;–নগ্ন নদী আর নগ্ন চর জড়িয়ে আছে পরস্পরকে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো?
মেঘা বলে, মনে হচ্ছে আমি নেই, আমি নেই, আমার জন্ম হয় নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, উঠবে?
মেঘা বলে, এরপর যে আর উঠতে হবে সেকথা মনে পড়ে নি।
হাসান বলে, জড়িয়ে থাকবো?
মেঘা বলে, যতো দিন বেঁচে আছি। যতো দিন ম’রে আছি।
হাসান বলে, আজ অ্যাডে যাবো না।
মেঘা বলে, আজ আমি রৌদ্রেও যাবো না।
হাসান বলে, এই প্রথম আমার জীবনে একটি সম্পূর্ণ রাত্রি এলো, এই রাত্রির স্বপ্ন দেখেছি সারাজীবন। তুমি আমাকে রাত্রি দিলে।
মেঘা হেসে বলে, রাত্রি দেয়ার জন্যে আমাকে ধন্যবাদ?
হাসান বিব্রত হয়ে বলে, না, না, ধন্যবাদ নয়, ধন্যবাদ নয়, অন্য কিছু।
মেঘা বলে, স্বপ্ন দেখার আগেই আমার জীবনে এলো অপূর্ব রাত্রি; আপনি আমাকে রাত্রি দিলেন।
হাসান বলে, তার জন্য আমাকে ধন্যবাদ?
মেঘা বলে, না, আমার জীবন।
হাসান বলে, এ-রাত আর কখনো আসবে না।
মেঘা বলে, আসবে, ফিরে ফিরে আসবে; আমরা হয়তো বুঝতে পারবো না ফিরে ফিরে আসছে। এই রাতই।
হাসান উঠে কেটলি চালু করে; মেঘা লাফিয়ে উঠে শাড়ি জড়িয়ে বলে, আমি চা বানাই, এটাই তো আমি ভালো করি।
হাসান বলে, এই অরণ্যে আর শাড়ি কেনো?
মেঘা জিজ্ঞেস করে, পরবো না? হাসান বলে, যখন আমরা এই অরণ্যে তখন কোনো অশ্লীল পোশাক নয়, বস্ত্ৰ হচ্ছে অসভ্যতা অশ্লীলতা।
মেঘা বলে, তাহলে তাই।
হাসান মেঘার স্তন ছুঁয়ে বলে, এখানে এই চাকাচাক লাল দাগ কেনো? মেঘা বলে, সারারাত এক চিতাবাঘের মুখে ছিলাম।
হাসান বলে, চিৎকার করো নি কেনো? উদ্ধার করতাম।
মেঘা বলে, উদ্ধার চাই নি, চেয়েছি চিতাবাঘ আমাকে খেয়ে ফেলুক।
হাসান বলে, খেয়ে ফেলে নি ব’লে দুঃখ হচ্ছে?
মেঘা বলে, চিরকাল তার দাঁতে গাঁথা থাকবো, সে খাবে, আবার খাবে, আমি ফুরোবো না; চাকচাক দাগের অলঙ্কার প’রে থাকবো।
একটি সম্পূর্ণ রাতের পর একটি সম্পূর্ণ দিনও আসে, শুধু তাদের জন্যে, আর কারো নয়, শুধু তাদের জন্যে–একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত করতলগত দিন; যদিও দিনরাত্রির পার্থক্য বুঝতে পারে না তারা, বোঝার কোনো দরকার হয় না, বোঝার কথা মনে পড়ে না; দিন ও রাত একই জিনিশের দুই রকম উৎসারণ মনে হয় তাদের, একই আলো কখনো অন্ধকার হয়ে দেখা দেয়, একই অন্ধকার কখনো দেখা দেয় আলো হয়ে। ওই সম্পূর্ণ দিনটিও তারা কাটিয়ে দেয় বা অধিকার ক’রে রাখে হাসানের ঘরের গভীর বিজন ছায়াঘন ঝরনামুখর আদিম অরণ্যে; সারাদিন ধ’রে হাতিরা ডাকে- ডাকে, বাঘেরা ডাকে- ডাকে, হরিণের ডাকে- ডাকে; সুন্দর জ্বলজ্বলে চিতার দাঁতে ঝুলতে বুলতে একজন হরিণী হাহাকার করতে থাকে পরম সুখে, ঘাই হরিণীর রক্তের আবেদনে সাড়া দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে জেগে থাকে এক পুরুষহরিণ, ভাসতে থাকে সুখ ও অবসাদের মধ্যে, আনন্দ ও যন্ত্রণার মধ্যে; সম্পূর্ণ দিন ভরে আদিম অন্ধকার, সম্পূর্ণ দিন ভ’রে আদিম উজ্জ্বল জ্যোৎস্না; সম্পূর্ণ দিন ভরে শরীর, সম্পূর্ণ দিন ভ’রে হৃদয়। পাহাড় বেয়ে বেয়ে উঠতে উঠতে পুরুষ এক সময় গড়িয়ে পড়ে প্রবালখচিত উপত্যকায়, ঢুকতে থাকে আদিম গুহায়, বল্লমে সুসজ্জিত, অপরাজেয় অক্লান্ত, এবং মহাক্লান্তিতে বিধ্বস্ত; নারী খুঁজে পায় এক অদ্ভুত আশ্রয়, যা উঠে গেছে আকাশের দিকে, দৃঢ় বলিষ্ঠ উদ্ধত, যার ভীতিকর সৌন্দর্যে তার চিৎকার আনন্দ হয়ে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে।
সারাদিন ভরে মাংসের, সারাদিন ভ’রে হৃদয়ের উৎসব।
সন্ধ্যায় মেঘা বলে, এবার যেতে হবে।
হাসান বলে, যাওয়ার দরকার নেই, টেলিফোন ক’রে জানিয়ে দাও তুমি এখানে আছো, এখানে থাকবে।
মেঘা বলে, এখানেই তো থাকবো, তবে আজ যেতে হবে।
হাসান বলে, কেনো?
মেঘা বলে, পুরোপুরি আসার জন্যে।
সন্ধ্যার পর হাসান মেঘাকে এগিয়ে দিয়ে আসে মেঘাদের বাড়ির সামনের পথ পর্যন্ত, রিকশা থেকে নেমে সে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফেরে।
একরাশ কবিতা এসেছে মাথার ভেতরে, বহু দিন পর প্রেমের কবিতা; বহু দিন পর কম্পিত কবিতা।
রাতেই খসড়া লেখা হয়ে যায় তিনটি কবিতার।
কবিতা, তুমি এসেছে, এসো।
মধ্যরাতে মেঘা ফোন করে, আমি এখানে ঘুমোতে পারছি না, মনে হয় দোজখে পড়ে আছি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কোথায় ঘুমোতে চাও?
মেঘা বলে, ওই বিজন অরণ্যে, যেখানে আছেন উজ্জ্বল চিতাবাঘ।
হাসান বলে, এর থেকেও বিজন অরণ্যে যাওয়ার কথা ভাবছি। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই মধুপুর জঙ্গলে যেতে চাই- অরণ্য, অরণ্য, পৃথিবী জুড়ে শুধুই অরণ্য, আর কিছু নেই অরণ্য ছাড়া, বাঘ ও হরিণ ছাড়া।
মেঘা বলে, আগামীকালই।
হাসান বলে, ইচ্ছে করছে এখনই, কিন্তু ব্যবস্থা করতে হবে, সেখানে আছে একটি অপরূপ কুটির।
মেঘা বলে, আমি তার স্বপ্ন দেখা শুরু করছি।
কয়েক দিন পর মধুপুর অরণ্যে বেড়াতে যায়। তারা, তিন দিনের জন্যে। মেঘা বাসায় ব’লে আসে বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে সিলেট।
কুটিরে উঠেই হাসান মালিটিকে বলে, আপনি কি সন্ধ্যায় ফুলপাতা এনে দিতে পারবেন?
মালিটি বলে, পারুম ছার, কি ফুল আনুম?
হাসান বলে, এ-বনে যতো সুগন্ধি পাতা আছে ফুল আছে, সব আনবেন, সবুজ পাতা আর রঙিন ফুল।
মালিটি জিজ্ঞেস করে, কতগুলি লাগবো ছার?