মেঘা বলে, তাহলে এখানে আমাকে খুব কুৎসিত দেখাচ্ছে।
হাসান বলে, যেমন পঙ্কে পদ্মকে কুৎসিত দেখায়।
তারা গিয়ে বসে বুফেই রেস্তোরাঁয়।
মেঘা বলে, এমন সুন্দর রেস্তোরাঁ কখনো দেখি নি।
হাসান বলে, এখানে হয়তো ১০১টি বা ৫০০৫টা খাবার আছে, যতো পারো খাও, দাম ৪০০ টাকা, এক টুকরো মাছও ৪০০ আর সব খেলেও ৪০০।
মেঘা বলে, তাহলে আমি সব খাবো।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি কি খেতে খুব পছন্দ করো?
মেঘা বলে, না; তবে এতো খাবার দেখে আমি পাগল হয়ে গেছি।
হাসান বলে, প্রকৃত পাগল?
মেঘা বলে, আমাদের রাস্তার পাগলটার মতো পাগল, রেলস্টেশনের পাগলীটার মতো পাগল, আমি আজ পাগলের মতো খাবো, খেয়ে খেয়ে ১০০০ কেজি হয়ে যাবো, যাতে আর না খেতে হয়।
হাসান বলে, খাও, ১০০,০০০ কেজি হও, আদিম ভেনাস হও। আদিম ভেনাসকে আমি ভালোবাসি।
মেঘা চঞ্চল বালিকার মতো প্লেট ভ’রে খাবার আনতে থাকে, কিছুটা খেয়ে আর খেতে পারে না; কিন্তু আরো খাবার পড়ে আছে সারিসারি, চেনা আর অচেনা, সেগুলো সে আনে নি, সেগুলো খেয়ে দেখতে হবে, নতুন প্লেট নিয়ে আবার সেগুলো আনতে যায়, আপ্যায়নকারীরা প্লেটের পর প্লেট নিয়ে যেতে থাকে, মেঘার প্লেটে খাবারের পাহাড় পড়ে থাকে, আনে, এক টুকরো খায়; হাসান একমুঠো ভাত, মাছ, শজি, ফল নেয়, আর নেয় ফরাশি মদ।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি কি একটু পান করবে?
মেঘা হাসানের পাত্র থেকে একটু পান ক’রে বলে, খুবই মধুর লাগছে, এমন কিছু আগে কখনো খাই নি।
হাসান বলে, তোমার জন্যে এক পাত্রের কথা বলবো?
মেঘা বলে, না, না; আমি আপনার পাত্রেই মাঝেমাঝে চুমুক দেবো।
হাসান বলে, এই পাত্রটি তো আমার ওষ্ঠ।
মেঘা বলে, আপনার ওষ্ঠ আমার আঙুর।
তারা যখন হাসানের ঘরে গিয়ে ঢোকে তখন বেশ রাত; আলো জ্বালিয়েই হাসান বিস্মিত হয় যে ঘরটিকে আজ বিস্ময়করভাবে সুন্দর দেখাচ্ছে, তার ঘরটি এতো সুন্দর হলো কী ক’রে? এটা তো এতো সুন্দর ছিলো না। মেঝের ধূসর সোনালি ম্যাটে ঘাস গজিয়ে উঠছে সবুজ হয়ে, ঘাসফুল ফুটছে এদিকে সেদিকে, দেয়ালে দেয়ালে শিমুল, দিকে দিকে টলমল পুকুরে দুলছে লালপদ্ম নীলপদ্ম শ্বেতপদ্ম, ওই কোনায় উড়ছে। বসছে ডাকছে একটি দোয়েল।
মেঘা বলে, আপনার ঘরটি এতো সুন্দর!
হাসান হেসে বলে, তুমি হয়তো ভেবেছিলে এটা লালন ফকিরের আখড়ার মতো অলৌকিক দেখাবে।
মেঘা বলে, না, না, অমন ভাবি নি।
হাসান বলে, তবে আগে এটা এমন ছিলো না, আখড়ার মতোই ছিলো, কিছুক্ষণ আগে সুন্দর হয়ে উঠলো।
মেঘা বলে, কিছুক্ষণ আগে?
হাসান বলে, তুমি যেই পা রাখলে অমনি এটি হয়ে উঠলো সুন্দর।
মেঘা বলে, আমার পায়ে এমন যাদু নেই।
হাসান বলে, তুমি যখন আর পা রাখবে না, তখন এটা হয়ে উঠবে মেথরপট্টির থেকেও নোংরা।
মেঘা বলে, শুধু পা নয়, নিজেকেই আমি রাখবো।
হাসান বলে, কোথায়?
মেঘা বলে, এই স্বর্গে।
হাসান নিজের বুকটি দেখিয়ে বলে, তুচ্ছ স্বর্গে নয়, তুমি তোমাকে রেখো এইখানে, এই প্রচণ্ড অপবিত্র নরকে, যেখানে আগুন জ্বলছে জিহোভার ক্রোধের থেকেও তীব্রভাবে।
মেঘা বলে, ওখানেই থাকতে চাই আমি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, চা খাবে?
মেঘা বলে, চার কাপ পাঁচ কাপ দশ কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে।
হাসান বলে, খুব অস্থির লাগছে?
মেঘা বলে, প্রথম স্বর্গে গেলে যেমন অস্থির লাগবে।
হাসান বলে, তুমি স্বর্গের স্বপ্নে আছো, আমি আছি নরকের।
মেঘা বলে, আজ থেকে স্বৰ্গকে ছেড়ে দিলাম, নরককে নিলাম।
হাসান বৈদ্যুতিক কেটলিতে পানি গরম করে, মেঘা তার হাত থেকে কেটলি নিয়ে বলে, আমি বানাই।
হাসান বলে, পারো? মেঘা বলে, একটি কাজই আমি ভালো পারি- চা বানাতে।
হাসান চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, এটা তো চা নয়।
মেঘা চমকে উঠে বলে, খুব তেতো হয়েছে, খুব বাজে?
হাসান বলে, এক কাপ তরল রঙিন কবিতা, পড়ার জন্যে নয়, পানের জন্যে। চা খেতে খেতে হাসানের ডান হাতের আঙুলগুলো নিঃশব্দ, ঝরনাধারার মতো বয়ে চলে মেঘার বা হাতের আঙুলগুলোর দিকে, গিয়ে পড়ে আরেক ঝরনাগুচ্ছে- স্নিগ্ধ উষ্ণ অমল কোমল শীতল নিৰ্মল, নিঃশব্দ কলকল ধ্বনি উঠতে থাকে চারপাশের পাহাড় উপত্যকা বনভূমিকে সঙ্গীতে মুখর ক’রে; হাসান উঠে দাঁড়ায়, তার ওষ্ঠ দোয়েলের মতো গিয়ে বসে মেঘার ওষ্ঠে, ভোরের আগের নিঃশব্দ সুরে ভ’রে যেতে থাকে সমস্ত চরাচর; হাসানের মনে হয়। হাজার হাজার বছর পর সে ঢুকছে নিসর্গের ভেতর, সমস্ত নগর রাজধানি দুর্গ বিমানবন্দর চার তারা পাঁচতারা নিওন আলো অ্যাড পেছনে ফেলে ঢুকছে গভীর অরণ্যে, যেখানে পাতার সবুজ ফুলের সুগন্ধ, অরণ্যে, যেখানে গভীরতম ছায়া আর জ্যোৎস্না, অরণ্যে, যেখানে আকাশ ছড়ানো ময়ুরের পেখমের মতো; হাসান তার শরীর থেকে খুলে ফেলে সভ্যতার নোংরা ছেঁড়াফাড়া আবরণ, দাঁড়ায় আদিম পুরুষের মতো নগ্ন পর্বতচূড়োর মতো নগ্ন স্বপ্নের মতো নগ্ন, মেঘা তার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে, যেনো ঘুমিয়ে পড়ছে, আর জাগবে না; ধীরেধীরে সে মেঘার শরীর থেকে সরিয়ে দিতে থাকে সভ্যতার ছেঁড়া সিল্ক, হাসান দেখতে পায় তার চোখের সামনে আশ্বিনের নদীর মাঝখানে জেগে উঠছে একটি নতুন নগ্ন চর, আদিম সুন্দর অমল পলিময়; আমি এমন সুন্দর কিছু আগে দেখি নি, এমন নদী আগে দেখি নি, আগে দেখি নি এমন সুন্দর বাক, হয়তো চিরকাল অন্ধ ছিলাম, কখনো চাঁদ দেখি নি, এই প্রথম দেখলাম; সরোবর দেখি নি, দেখলাম। এই প্রথম, এমন জলে আগে সাঁতার কাটি নি কখনো, এই প্রথম সাঁতার কাটলাম; আমি ভ’রে যাচ্ছি বাঘের গায়ের গন্ধে ভ’রে যাচ্ছি হরিণীর মাংসের সুগন্ধে, অজস্র জেব্রার রঙে ভ’রে উঠছে জ্যোৎস্নায় মাতাল অরণ্য, দূরে শুনতে পাচ্ছি। মত্তহস্তীর মহান ডাক; হাতি ডেকে চলছে, হাতি ডেকে চলছে, হাতি ডেকে চলছে। বেরিয়ে পড়েছে অরণ্যের সব হাতিরা, সব বাঘেরা, সব হরিণের, সব জেব্রারা; সকলের শরীরে আজ তীব্রতম প্রেম, সকলের হৃদয়ে আজ অনিৰ্বাচনীয় আবেগ।