মেঘা বলে, তুচ্ছ বাসাটাসার কথাও আপনি ভাবেন?
হাসান বলে, হঠাৎ মনে হলো, অসুবিধা হ’তে পারে।
মেঘা বলে, আমি সেটা দেখবো, হলে থাকার কথা বলবো।
হাসান বলে, তোমার সাথে সারারাত কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
মেঘা বলে, আমারও ইচ্ছে করছে।
হাসান বলে, বলো, অনন্তকাল ধ’রে বলো।
মেঘা বলে, কিন্তু লুকিয়ে আর বেশি কথা বলতে পারছি না।
হাসান বলে, কাল বিকেলে অফিসে এসো।
মেঘা বলে, আমি এসেছি।
মেঘা ফোন রেখে দিয়েছে, এখন আমি কী করতে পারি? কী করার আছে আর? পৃথিবীতে সব কাজ সমাপ্ত হয়ে গেছে, এখন যা আজ আছে সবই পুনরাবৃত্তি, করার অযোগ্য। আমার জীবনপাত্র কি ভ’রে গেছে কানায় কানায়, উপচে পড়ছে? এর পর আছে শুধু ক্লান্তি, আছে শুধু জোয়ারের পর নদী জুড়ে পোড়া কাঠের ছড়াছড়ি? এখন একমাত্র সুখকর কাজ হচ্ছে আত্মহত্যা, ভবিষ্যতের সমস্ত তুচ্ছতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া? সমগ্র জীবনযাপন করা হয়ে গেছে আমার? কিন্তু আত্মহত্যা নয়, আত্মহত্যা নয়, এখনি আত্মহত্যা নয়। ঘুমোবো? একটি কবিতা চোখের সামনে উড়ছে। কয়েক দিন ধ’রে, না কি সাঁতার কাটছে, সেটিকে ধ’রে ফেলতে চেষ্টা করবো অক্ষরের খাচায়? আরো কয়েক দিন উড়তে দেবো এলোমেলো? উড়ুক, কবিতাটি উড়ুক, জ্যোৎস্নায়, অন্ধকারে উড়ুক, সাঁতার কাটুক, জলে, গভীর জলের ভেতরে; কিন্তু ঘুম? কোথায়? কেনো? কখন? কতো শতাব্দী? অনন্তকাল? হাসানের চোখে পড়ে একটি সংস্কৃত ব্যাকরণের ওপর, ইংরেজিতে লেখা, লিখেছেন এক এডিনবরি অধ্যাপক,–মহান বৈদিক ভারতীয়দের, আহা, আজকাল সংস্কৃত শিখতে হচ্ছে পাষণ্ড বেকনভোজি শাদাদের কাছে; অনেক দিন আগে কিনেছিলো, আজ রাতে–কবিতা নয়, কাব্যতত্ত্ব নয়, তার পড়তে ইচ্ছে করছে সংস্কৃত ব্যাকরণ। হাসান সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়তে থাকে, চমৎকার ভাষা সংস্কৃত— মেঘার মতোই। মেঘার মতোই? না, মেঘা। এতো সূত্র দিয়ে বাধা নয়, মেঘা সংস্কৃতকে ছাড়িয়ে গেছে আড়াই হাজার বছর আগেই। মেঘা কি প্রাকৃত? কোনটি? আটত্রিশটির কোনটি? মহারাষ্ট্ৰী? শৌরসেনী? মাগধী? পৈশাচী? কোনটি? মেঘা কি অবহট্ঠ? মেঘা কি অবহট্ঠ ভেঙে হয়ে উঠছে বাঙলা? কায়া তরুবর পাঞ্চ কি ডাল? প্রাচীন ব্যাকরণ জানা দরকার কবিকে, সব মৃত ভাষার ব্যাকরণ–যদি সে আউল বাউল ঝাউল না হয়, আধুনিক কবি হয়। লাতিন ব্যাকরণ পড়লে কেমন হয়? প্রিস্কি আনের ব্যাকরণ? গ্রিক ব্যাকরণ? থ্রাক্সের ব্যাকরণ? পাণিনির ব্যাকরণ কি পড়ার চেষ্টা করবো একবার? কাত্যায়ন? পতঞ্জলির মহাভাষ্য?
বিকেলে, হাসানের যেটাকে ঠিক সময় মনে হয়েছিলো, তার আগেই মেঘা আসে; মেঘাকে দেখে হাসানের মনে হয় তার কবিতা আজো এতো শিল্পময় হয়ে উঠতে পারে নি; শুধু তার নয়, কোনো কবিতাই এতো শিল্পিত সুন্দর নয়।
মেঘা কি কবিতার থেকে উৎকৃষ্ট? কবিতা কি মেঘারই নিকৃষ্ট অনুকরণ?
মেঘা শিল্পকলার থেকেও স্মিত হেসে বলে, আমি এসেছি।
হাসান বলে, কিন্তু আর কেউ আমার কাছে এমনভাবে কখনো আসে নি।
মেঘা বলে, একমাত্র আমিই জন্মেছি আপনার কাছে আসার জন্যে।
হাসান বলে, তোমার পিতা ও মাতাকে ধন্যবাদ।
মেঘা বলে, আপনার কাছে আসবো ব’লে আমার পিতাকে কোনো কষ্ট করতে হয় নি, তবে মাকে দশটি শেলাই নিতে হয়েছিলো।
হাসান বলে, কবিতাও কখনো এভাবে আসে নি। আসা শব্দটির অর্থ আজ আমি প্রথম অনুভব করছি, আসা শব্দটির অর্থ যেনো কী?
মেঘা বলে, একদিন আমি আপনার কাছে আসবো এজন্যেই আমার আপনার জন্ম হয়েছিলো, আসা শব্দের অর্থ হচ্ছে মেঘার জন্ম।
হাসান বলে, তুমি একটু দেরিতে জন্ম নিয়েছে।
মেঘা বলে, না, ঠিক সময়েই জন্ম নিয়েছি; ঠিক একুশ বছর পরে। আপনি আমার একুশ বছর ছোটো।
হাসান বলে, কাল সারারাত আমি সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়েছি, আর আজ দুপুর থেকে একটি পিলের অ্যাডের স্ক্রিপ্ট সংশোধন করছি।
মেঘা হেসে বলে, কোনোটিই আমি খাই নি। হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি কি এক ঠোঙা পিল খেয়ে দেখবে? চমৎকার সুস্বাদু পিল, আমেরিকায় তৈরি।
মেঘা হেসে বলে, দিন, মরিচ, আর লবণ আছে তো?
হাসান বলে, ভেজে খাবে না, না ভর্তা ক’রে খাবে?
মেঘা বলে, ভর্তা ক’রে খেতেই ভালো লাগবে।
মেঘা বলে, আপনি বললে খাবো।
হাসান বলে, তুমি কি পিলটার মডেল হবে?
মেঘা বলে, আজ তো আমি মডেল হতে আসি নি; আজ আমি প্রিয়তমা।
হাসান একটু বিব্রত হয়, এবং বলে, মেঘা, পুঁজিবাদ প্রিয়তমাকেও বিক্রি করে, প্রিয়তমার গ্ৰীবার তিল, গালের টোল, স্তনের উচ্চতা, পাছার প্রশস্ততাও বিক্রি করে; সবই পণ্য; তবে তোমাকে আমি বেচতে চাই নি।
মেঘা বলে, তা আমি জানি।
সন্ধ্যার একটু পর তারা একটি পাঁচতারা হোটেলে যায়।
মেঘা বলে, এ-হোটেলে কখনো ঢুকবো ভাবি নি, এতো ঝলমলে, এতো সুন্দর, এতো অপূর্ব, এতো অচেনা, এটা কি তাজমহল?
হাসান বলে, আমিও কখনো ঢুকবো ভাবি নি, এটাকে এক সময় বিদেশ মনে হতো আমার, পাসপোর্ট ছিলো না।
মেঘা জিজ্ঞেস করে, কখন ভাবলেন?
হাসান বলেন, ভাবি নি; অই স্বাধীনতাটা আমাকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে, ধন্যবাদ গরিব স্বাধীনতা, আমি কৃতজ্ঞ, হে গরিব স্বাধীনতা।
মেঘা বলে, এখানে গরিব কই? ছেঁড়া লুঙ্গিপারা ভাইরা কই? এই কার্পেটে তারা হাঁটলে কী সুন্দর দেখাতো।
হাসান বলে, তাদের আমরা দেশ জুড়ে স্বাধীনতা দিয়েছি, এই নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত; গরিবরা বস্তিতে সুন্দর, ধনীরা হোটেলে।