মেঘা বলে, আপনি আমার থেকে দূরে থাকতে পারবেন না।
হাসান বলে, মেঘা, তুমি যাও, আর এসো না।
মেঘা বলে, আমি এসেছি।
হাসান বলে, মেঘা, আমি জানি তোমার অপূর্ব স্তন রয়েছে ঠোঁট রয়েছে নদী রয়েছে, কিন্তু আমি ওই অপূর্বদের কাছে যেতে পারবো না।
মেঘা বলে, আমি এসেছি, আমি অপূর্ব।
হাসান একটি সিগারেট ধরায়, টয়লেটে যায়, টয়লেটে গিয়ে আয়নায় নিজের মুখটি দেখে; সে স্বস্তি পায় যে নিজের মুখটি সে চিনতে পারছে, মুখটিকে তার ভালো লাগছে, টয়লেটে ঢোকার আগে আর মনে হচ্ছিলো নিজের মুখ সে চিনতে পারবে না, কুৎসিত দেখাবে, সে চিনতে পারছে, মুখটিকে ভালো লাগছে; তার একটি শিশ্ন রয়েছে, সেটি সে ধ’রে দেখে, তারও প্রাণ রয়েছে। হাসানের বসতে ইচ্ছে করে; একটি চেয়ার থাকলে বেশ হতো, তার মনে হয়, জীবন থেকে সব ধরনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসার জন্যে টয়লেট শ্ৰেষ্ঠস্থান; সে কমোডের ওপর বসে এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে সিগারেটে টান দিতে দিতে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, হাসান, তুমি কি সত্যিই চাও এ-মেয়ে এ-বিশ বছর আর না আসুক? তুমি কি তার দীর্ঘ কালো চুল দেখতে চাও না? তুমি কি ওই মসৃণতায় ডুবে যেতে চাও না? তুমি কি তাকে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে চাও না? তুমি কি তার নিশ্বাসে সুস্থ হ’তে চাও না?
সে কি চিরকাল বসে থাকবে টয়লেটে? বেরোবে না? সে বেরিয়ে আসে।
মেঘা জিজ্ঞেস করে, টয়লেটে ব’সে কি আপনি কবিতা লেখেন?
হাসান বলে, হ্যাঁ, লিখি।
মেঘা জিজ্ঞেস করে, আজ কী কবিতা লিখলেন?
হাসান বলে, আমার পরিণামের কবিতা।
মেঘা বলে, আমি আজ যাচ্ছি, কিন্তু আমি এসেছি, আপনাকে দেখে মনে হয় আমার আসার জন্যে আপনি জন্মজন্ম ধ’রে অপেক্ষা করছিলেন, আপনি আমার অভাবে ছিলেন। আমি এসেছি, আপনার আর কোনো অভাব নেই।
হেসে বেরিয়ে যায় মেঘা; হাসানের মনে হয় জন্মজন্মান্তর ধ’রে সে শূন্যতার মধ্যে আছে, অতল অনন্ত অগাধ অন্ধকার শূন্যতার মধ্যে সে অনন্ত শূন্যতা হয়ে আছে। এটাই বেশ, সে এভাবেই থাকতে চায়; সে কোনো মানবিক পূর্ণতা চায় না, শুধু চায় শিল্পকলার পূর্ণতা। একটি শ্যামলী কী? একটি মেঘা কী? তারা কবিতা নয়, শব্দের অপূর্ব বিন্যাস নয়, ছন্দ নয়, অভাবিত চিত্রকল্প নয়; তারা স্তন, ওষ্ঠ, যোনি, জরায়ু, সংসার, কচুশাখ, ইলশে মাছ, কাঁচামরিচ, ধনে পাতা, রাবার, পিল, রাবারহীনতা, ঋতু, বারো দিনের পর উর্বরতা, শিশু, আবার শিশু, এবং শিশু। আমি কি এই চাই? আমি এটা চাই না, জীবন চাই না, শিল্পকলা চাই।
বেশ রাতে বাসায় ফিরে হাসানের ইচ্ছে হয় স্নান করতে; সে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার খুলে ঝরনাধারার নিচে নগ্ন নাচতে থাকে, শিশুর মতো, যেনো জোয়ার এসেছে খালেবিলে, সে লাফিয়ে পড়ছে জোয়ারের জলে, নিজেকে সে জিজ্ঞেস করতে থাকে তার আজ এই রাত বারোটায় স্নান করতে ইচ্ছে হলো কেনো? আমি জানি না, আমি জানি না; হাসান নিজেকে বলতে থাকে, হাসান, তুমি আমাকে আজেবাজে প্রশ্ন কোরো না, আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না, আমি উত্তর জানি না, আমার শাওয়ারের নিচে নগ্ন নাচতে ভালো লাগছে, এই জানি আমি, ভালো লাগলে সারারাত আমি শাওয়ারের নিচে নাচবো।
বেডরুমে কি টেলিফোন বেজে চলছে? না কি জলের শব্দ? জলপ্রপাতের শব্দ? টেলিফোন বাজছে? হ্যাঁ, বাজছে; বাজুক, আমি জোয়ারে ভাসছি, টেলিফোনের কোনো সংবাদ আমি জানি না, জোয়ারের জলে কোনো টেলিফোন নেই, আমি শুধু জলের স্বর শুনতে চাই, জলের ছোঁয়া পেতে চাই। থামছে? আবার বাজছে? বেজে চলছে? অনন্তকাল বেজে চলবে? মধ্যরাতে অ্যাড? বোতলে ভরা হয়ে গেছে নতুন শ্যাম্পু? উৎপাদিত হয়ে গেছে কোনো ২০০% হালাল সাবান? কাল ভোরেই বাজারে আসবে নতুন পিল? ব্যবসা, ব্যবসা, ব্যবসা; ব্যবসায়ী গ্রহটির বেশি সময় নেই; উৎপন্ন হয়ে গেছে, ফেলে রাখা চলে না, এখন বেচতে হবে, দিনরাত বেতে হবে; তাকে বেশি বাজতে দেয়া ঠিক হবে না।
হাসান ভেজা শরীরে, চুল থেকে ঝরঝর ক’রে জোয়ার করছে, বেরিয়ে আসে; টেলিফোন ধ’রে বলে, হ্যাঁলো, হাসান বলছি।
মেঘা বলে, আমি সন্ধ্যে থেকে ফোন ক’রে চলছি, পাগল হয়ে আছি।
হাসান বলে, ফিরতে দেরি হয়েছে, ফেরার ইচ্ছে ছিলো না; আমি হয়তো পাগল হয়ে গেছি।
মেঘা জিজ্ঞেস করে, কেনো দেরি করলেন?
হাসান বলে, পাগল হয়ে গিয়েছিলাম বলে পথ চিনতে পারি নি।
মেঘা বলে, পাগল হয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?
হাসান বলে, পান করতে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম সেখানেই ঘুমিয়ে পড়বো।
মেঘা জিজ্ঞেস করে, এখন কী করছিলেন?
হাসান বলে, বাথরুমে শাওয়ারের নিচে নাচছিলাম—পাগল হয়ে।
মেঘা বলে, আপনি নাচতে জানেন?
হাসান বলে, পাগল হ’লে নাচতে জানি।
হাসান মেঝেতে বসে, তার মনে হয় তার ওপর ঝরে পড়ছে ঝরনাধারা, আকাশ থেকে, মেঘমণ্ডল থেকে।
মেঘা বলে, আপনাকে না পেলে আমি সারারাত ফোন ক’রে চলতাম।
হাসান বলে, তুমি কি এখন আসতে পারো?
মেঘা বলে, এই রাত সাড়ে বারোটায়?
হাসান বলে, হ্যাঁ।
মেঘা বলে, আমার আসতে ইচ্ছে করছে, বেরিয়ে পড়োতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এখন কি আমি আসতে পারি?
হাসান বলে, তাহলে কাল আসবে, আমার সাথে সারারাত থাকবে।
মেঘা বলে, থাকবো।
হাসান জিজ্ঞেস করে, বাসায় অসুবিধা হবে না?