ধন্যবাদ, ঢাকা, ধন্যবাদ তোমাকে; তুমি বদমাশের, তুমি কবির।
অনেক বছর পর একটি কবিতা লিখে সে শারীরিক পুলক বোধ করে। তার মনে হয় অনেক বছর পর সে একটি পরিতৃপ্ত সঙ্গমের স্বাদ পেলো, দীর্ঘ সর্বাঙ্গ বহুতল বহুপ্রকোষ্ঠময়।
কবিতা কি আমার শরীরের সাথেও জড়িত? জড়িত অণ্ডকোষের সাথেও? হাসান নিজের ভেতরে তাকায়। কবিতাটি আমাকে কেনো ক্ষরণের সুখ দিলো, যেমন ক্ষরণের সুখ আমি অনেক দিন পাই নি? কবিতা কি আমার মগজ থেকে দূরে? কবিতা কি আমার অণ্ডকোষ আর শিশ্নের সন্তান?
কবিতা তুমি এভাবেই এসো, আমাকে কাঁপিয়ে এসো, শিউরে দিয়ে এসো, ভেঙে এসো, আমাকে পুলকিত নিস্তেজ মৃত্যুর স্বাদ দিয়ে রচিত হয়াে। আমার চােখ রক্ত মাংসের ভেতর দিয়ে এসো, আমার শরীরকে শুষে তুমি নির্গত হয়ো। কবিতা, মৃত্যু হয়ে এসো, আমার, জীবন হয়ে এসো।
আরেকটি পংক্তি তার মাথায় ঢোকে একটি ট্রাক তার রিকশার পেছনে শহর কাঁপিয়ে ব্ৰেক কষতেই, ব্রেকের শব্দে চাকার নিচে পড়া অজস্র রিকশার চিৎকারের মতো এইবার কবিতাটি বেজে ওঠে তার ভেতরে।
সে পেছনে ট্রাকটির দিকে তাকিয়ে বলে, ধন্যবাদ, ট্রাক, তুমি আমাকে একটি পংক্তি দিয়েছাে; তুমি মৃত্যুর থেকেও সুন্দর, জীবনের থেকেও অপরূপ।
ট্রাকটি যেনো বলে, ধন্যবাদের কথা বলো না, কবিতা লেখো।
সে-রাতেই কবিতাটিকে সে কাগজে জন্ম দেয়।
কিন্তু এই শহর অন্যের হয়ে গেছে, এককালে এই রূপসী তারও দখলে ছিলো; তারও স্যান্ডলের শব্দে এই পংকিল তিলোত্তমা বুঝতো সে হাঁটছে; এখন অন্যদের দখলে, অভিচারিণী তাকে চিনতে পারছে না, তার স্যান্ডলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু শহর, মায়াবিনী, সুন্দরী রূপসী, অপূর্ব পংকিলা, আমার স্যান্ডলের শব্দ তোমাকে শুনতেই হবে, যেমন শুনতে একদিন, তুমি শুনবে, শুনতেই হবে, পৃথক দুরূহ গভীর অন্তরঙ্গ নির্মম স্যান্ডলের শব্দ- হাসান শহরের কানে কানে নিঃশব্দে বলে। একদা বন্ধু কবিদের আড্ডায় গিয়ে দেখছে একটি ক’রে কবিতার বই বেরিয়েছে অনেকের, আর তাদের মাথা আকাশে ঠেকে গেছে; তারা কবি, সে কেউ নয়; তাদের পায়ের নিচে পড়ে আছে বাঙলা কবিতা, দয়া ক’রে তারা তাদের ছেঁড়া জুতো দিয়ে কবিতা মাড়াচ্ছে, ধন্য হচ্ছে কবিতা।
আড্ডায় গেলেই হাসানের মনে হয় সে একদল দণ্ডিত ছিন্নভিন্ন মানুষ দেখছে, যারা বুঝতে পারছে না যে তারা দণ্ডিত ছিন্নভিন্ন। কাদের আবদুল, বিভূতিভূষণ মণ্ডল, সালেহ ফরিদউদ্দিন, আহমেদ মোস্তফা হায়দার খুবই দাপটের সাথে আছে; তারাই কবিতার যুবরাজ; একেকটি লিটল ম্যাগাজিন দুই হাতে আঁকড়ে তারা ভাগ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দলে, নিজেদের লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপছে— ছাপছে দৈনিকের সাময়িকীতেও, বন্ধুদের দিয়ে নিজেদের কবিতা সম্পর্কে তিরিশ পাতার প্রবন্ধ লেখাচ্ছে, প্রশংসা লেখাচ্ছে শহরের জীবাশ্ম বুড়োদের দিয়ে, কেউ কেউ লিখছে না, সম্পাদনা করছে লিটল ম্যাগাজিন, পালন করছে গুরুর ভূমিকা, হয়ে উঠছে কবিতার পৃষ্ঠপােষক সন্ত। কবিতার শহর এখন তিন চারটি যুবরাজের, আর দুটি একটি কবিতার সন্তের।
এক সন্ধ্যায় গুলিস্থানের উত্তরের এক রেস্তোরাঁয় খুব জমজমাট ঘোলাটে তীব্ৰ আড্ডা জমে। আড্ডায় মহারবীর সন্ত রহমত আলি মাহমুদ আছে, আর আছে কবিতার যুবরাজগণ–কাদের আবদুল, সালেহ ফরিদউদ্দিন, বিভূতিভূষণ মণ্ডল, আহমেদ মোস্তফা হায়দার, এবং আরো কয়েকটি তরুণ কবি, যারা হয়তো বই পুড়িয়ে ফেলা ছাত্র, যাদের হাসান চেনে না, কিন্তু তাদের চোখে মুখে ভাঙা চোয়ালে চুলে গালে পাঞ্জাবিতে ঝুলছে কবিত্বের পরাকাষ্ঠা।
আড্ডায় যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে কবি নয়, সে এক মাংসল ভনিতা; সে কবিতার সন্ত রহমত আলি মাহমুদ। এই বিপুল হা হা সন্তকে হাসান আগেও দেখেছে, জন্মসূত্রেই মহাপুরুষের মতো ভাব, কিন্তু হাসানের মনে হয়েছে সে আপাদমস্তক শূন্য, শুধু ঠোঁট শুধু গলা, শুধু প্রচ্ছদপট, শুধু হা হা হাস্য, তাই তার কাছে কখনো যায় নি। সে কোনো লিটল ম্যাগাজিনের নিজস্ব কবি হ’তে পারে নি। এবার দেখছে সন্ত আরো প্রতিষ্ঠিত, কবিতার মহাগুরু, সেই ঠিক ক’রে দিচ্ছে সে কবি আর কে কবি নয়, কে কবি হবে। আর কে হবে না।
কবিতার অভিভাবকেরা চিরকালই আস্ত অকবি, হাসান মনে মনে বলে, রহমত আলি মাহমুদ তুমি কখনো কিছু হবে না, তুমি একটা শূন্য।
সন্ত রহমত আলি মাহমুদ বলে, বাঙলা কবিতা এখন তাকিয়ে আছে আমাদের লিটল ম্যাগাজিন ‘চর্যাপদ’-এর দিকে,–আমাদের লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া বাঙলা কবিতার আর কোনো পথ নেই। আমাদের ম্যাগাজিনের অ্যাভেনিউ দিয়েই বাঙলা কবিতাকে ইটারনিটির দিকে যেতে হবে।
হা হা ক’রে হাসে সন্ত রহমত আলি মাহমুদ।
টেবিলের চারদিকে গাঁজাভরা সিগারেটের ধুঁয়ো, ঘোলাটে চায়ের কাপের খুব দ্রুত জ’মে উঠছে ম্রিয়মাণ ছাঁই, আর অনন্ত অপচয়।
কাদের আবদুল বলে, মাহমুদ ভাই, আপনি আছেন ব’লেই আমরা কবি, আপনি সৃষ্টি করছেন কবি, যা কবিতা লেখার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাঙলা কবিতার ইতিহাসে কেউ আর এভাবে কবি তৈরি করে নি।
হাসান ব’লে ওঠে, বুদ্ধদেব বসু?
কাদের আব্দুল বলে, বুদ্ধদেব বসুকে ভুলে যান, সে ছিলো ডাকযোগে কবি করার সম্পাদক, মাহমুদ ভাই তার থেকে অনেক বড়ো, মাহমুদ ভাই আমাদের কবিতার প্রফেট।