হাসান বলে, আমাকে নিয়ে তুমি সুখ পাবে না।
মেঘা বলে, তা কেউ জানে না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তোমার বয়স কতো?
মেঘা বলে, বিশ।
হাসান বলে, আমার একচল্লিশ।
মেঘা বলে, আমার থেকে আপনি একুশ বছরের ছোটো, এটাই আমার পছন্দ।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
মেঘা বলে, কোলে নিতে পারবো, আবার পায়ের নিচে বসাতে পারবো; পিতা বলতে পারবো আবার পুত্র বলতে পারবো।
হাসান বলে, একটি নারীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো, দশ বছর ধ’রে।
মেঘা বলে, তাতে কিছু আসে যায় না।
হাসান বলে, তুমি নিশ্চয়ই এমন একটি পুরুষ চাও, যার কামের অভিজ্ঞতা নেই, যে সচ্চরিত্র, তুমিই যার প্রথম নারী। একদিন সে হবে তোমার পবিত্র কবিনে সইকরা কবুল কবুল হাজব্যান্ড, যে তোমার জন্যে শাড়ি কিনে আনবে, ধনে পাতা আর কইমাছ কিনে আনবে।
মেঘা বলে, কী ক’রে জানলেন আমি আমন পুরুষ চাই, ধনে পাতা আর কইমাছ?
হাসান বলে, এটাই তো চায় মেয়েরা; তাদের শরীর এই চায়।
মেঘা হেসে বলে, অভিজ্ঞতাহীন পুরুষ এখন পাওয়া যায়? শুনেছি নপুংসকেরাই শুধু অনভিজ্ঞ; আর হাজব্যান্ড নিয়ে আমি ভাবি না।
হাসান বলে, কয়েক দিন পরই ভাবতে শুরু করবে–হাজব্যান্ড, হাজব্যান্ড–এটার বাঙলাটা যেনো কী?
মেঘা বলে, এটা আপনার ভুল ধারণা; হাজব্যান্ড আর স্বামী একটাকে নিয়েও আমি ভাবি না।
হাসান বলে, আমাদের পতিতারাও খদ্দেরকে ওপরে চড়িয়ে মনে করতে থাকে ভদ্রলোকটি তার হাজব্যান্ড;–সে সতী, সে পবিত্র ধর্মকর্ম করছে।
মেঘা বলে, আমি পতিতা নাই, সতীও হ’তে চাই না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তোমার কি অভিজ্ঞতা আছে?
মেঘা বলে, একটু আগে অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমার ভালো লেগেছে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আরো অভিজ্ঞতা চাও?
মেঘা বলে, আপনার সাথে যে-কোনো অভিজ্ঞতায়ই আমি সুখ পাবো, আপনার সাথে সব অভিজ্ঞতার জন্যেই আমি এখন থেকে প্ৰস্তৃত; আমার মন আমার শরীর প্রস্তুত, সব অভিজ্ঞতা আমার ভালো লাগবে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, এখনই যদি আমি তোমাকে আমার শয্যাকক্ষে নিয়ে যেতে চাই, তুমি যাবে?
মেঘা হাসানের মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে বলে, যাবো।
হাসান একটি কবিতার বই বের ক’রে উপহার দেয় মেঘাকে- ‘মেঘাকে, ভালোবাসা নয়, বিপর্যয়, দুর্ঘটনা, অপার অভিজ্ঞতা’।
মেঘা বলে, এটা আমার পাওয়া মধুরতম উপহার, চিরকাল থাকবে।
হাসান বলে, চিরকাল ব’লে কিছু নেই, চিরকাল ভুল ধারণা।
মেঘা বলে, আছে, আমি জানি আছে।
হাসান বলে, আজ থেকে আমাদের দুর্ঘটনার সূচনা হলো।
মেঘা বলে, আমাদের দুর্ঘটনা যেনো দীর্ঘ হয়।
হাসান বলে, আমি এক দশক দুর্ঘটনায় ছিলাম, হয়তো আরেক দশক দুর্ঘটনায় থাকবো, তারপর হয়তো আমি থাকবো না।
মেঘা বলে, আমাদের বাসার সবাই আপনার অনুরাগী, আমার ভাইবোনেরা, এমনকি আব্বাও। বিকেলে আপনি আমাদের বাসায় আসবেন, আমার নিমন্ত্রণ।
একটি ভয়াবহ দুৰ্ঘটনায় অংশ নেয়ার জন্যে তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে কেউ, বলছে তুমি লাফিয়ে পড়ো অগ্নিগিরিতে, গভীর গর্তে, সেখান থেকে তুমি আর উঠে আসতে পারবে না, এমন মনে হয় হাসানের। ভাইবোন, বাসা, আব্বা এসব হচ্ছে দাউদাউ আগুন; এসব থেকে সে দূরে আছে, অনেক দিন তার মনে পড়ে নি যে তার ভাইবোন আছে, একটি মা ও বাবা আছে— বাবাটির যেনো কী নাম?- মেঘার কথা শুনে তার তীব্র ভয় লাগে। এসব কি তার আছে? এসব তার থাকা দরকার? তার তো আছে শুধু শিল্পকলা। মা, বাবা, ভাইবোন তার কে? মা, বাবা, ভাইবোন শিল্পকলা নয়, তার কেউ নয়; সে তাদের কেউ নয়।
হাসান বলে, ভাইবোন, আব্বা, বাসা এসব শব্দের অর্থ আমি জানি না, মেঘা ৷ এসব শব্দের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই; এগুলোকে আমার খুবই অচেনা মনে হয়, যেনো এই আমি প্রথম শুনলাম।
মেঘা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার কি ভাইবোন, আম্মা, আব্বা নেই?
হাসান বলে, একটি নারীর কথা আমার মনে পড়ে, তার মুখ আমি মনে করতে পারি না, তাঁর জরায়ুতে আমি বিকশিত হয়েছিলাম, তিনি প্রসব করেছিলেন আমাকে, তিনি আদর করতেন আমাকে, আমার জন্যে হয়তো তার বুক ভেঙে আছে, তাকে দেখতে ইচ্ছে করে, তাঁর মুখটি আমি মনে করতে পারি না।
মেঘা ভয় পেয়ে বলে, কী যে বলেন। আপনি, কী যে বলেন।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি কি জানো তার মুখটি কেমন?
মেঘা বিব্রত হয়, কিন্তু একটু সময় নিয়ে বলে, আমি জানি আপনার মায়ের মুখটি কেমন।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মায়ের মুখটি কেমন?
মেঘা বলে, তার মুখটি দিঘির মতো, সারাক্ষণ টলমল করছে, যার চারপাশে অনেক গাছ, অনেক ছায়া, গভীর ছায়া, রাতে চাঁদের আলোতে ভরে যায়, যখন চাঁদ থাকে না তখন জোনাকি জ্বলে।
কাকে বলে, জোনাকি কাকে বলে?
মেঘা বলে, এসবই আমি আপনাকে ধীরেধীরে চিনিয়ে দেবো।
হাসান বলে, এসব আমার চিনতে ইচ্ছে করে না।
মেঘা বলে, আপনাকে অবশ্যই চিনতে হবে এসব।
হাসান বলে, তুমি আর এসো না; এসব আমি চিনতে চাই না।
মেঘা বলে, তাহলে আমি আজ যাবো না, আপনার সাথে থাকবো, যাতে আর আসতে না হয়।
হাসান বলে, একটি নারীর সাথে আমি দশ বছর সঙ্গম করেছি, জানি না তাকে প্রেম বলে কি না।
মেঘা বলে, তাতে কিছু যায় আসে না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমাকে তোমার নষ্ট মানুষ মনে হয় না?
মেঘা বলে, না; সৎ মানুষ মনে হয়।
হাসান বলে, আমি আর সঙ্গম করতে চাই না, আমি আর প্রেমে পড়তে চাই না; আমি নপুংসক হয়ে যেতে চাই, অপ্রেমিক হয়ে যেতে চাই। তিন বছর ধ’রে তাই আমি নারী থেকে, ঠোঁট থেকে, স্তন থেকে দূরে আছি; কবিতা ছাড়া আমার আর কিছু নেই।