শিল্পকলা হচ্ছে রক্তমাংসের বিপরীত; রক্তমাংস অশুদ্ধ শিল্পকলা বিশুদ্ধ।
তারাই প্রকৃত শহিদ, মৃত্যুবরণ করে যারা শিল্পকলার জন্যে, তারাই শুধু সৎ কারণে শহিদ হয় এবং বুঝতে পারে কেনো শহিদ হলো; অন্য শহিদেরা বুঝতে পারে না তারা কেনো মৃত্যুকে বেছে নিলো।
যা রক্তমাংস থেকে যতো দূরবতী তা ততো বেশি শিল্পকলা।
রক্তমাংস ও শিল্পকলার সহাবস্থান অসম্ভব, শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা একসাথে থাকতে পারে না। শিল্পকলা শুদ্ধ, রক্তমাংস অশুদ্ধ।
মানুষের পক্ষে শিল্প সৃষ্টি অসম্ভব, মানুষ শিল্পকলার নামে সৃষ্টি করে ভিন্ন ধরনের রক্তমাংস।
রক্তমাংসের পর আবার রক্তমাংস হাস্যকর।
সঙ্গম ও শিল্পসৃষ্টি সম্পূর্ণ বিপরীত; সঙ্গম সৃষ্টি করে নশ্বরতা, শিল্পকলা সৃষ্টি করে অবিনশ্বরতা।
শিল্পীকে হতে হবে নপুংসক, মাংসের শত্রু।
জনগণ শিল্পকলার বিপরীত; জনগণ হচ্ছে মাংস, লিঙ্গ, ক্ষুধা।
জনগণ এক টুকরো বাসি মাংস চায়, ‘অর্কেস্ট্রা’ চায়না, ‘অবসরের গান’ চায় না; তাই ‘অর্কেস্ট্র’ আর ‘অবসরের গান’ কবিতা বা শিল্পকলা।
মানুষের উৎপত্তি কদৰ্য ক্রীড়া থেকে, শিল্পকলার উৎপত্তি শুদ্ধতা থেকে।
সবচেয়ে ঘূণ্য হচ্ছে কাম, পবিত্র হচ্ছে কবিতা, যাতে কোনো রক্তমাংস নেই।
কাম কদৰ্য, শিল্পকলা শুদ্ধ।
লিঙ্গহীন পুরুষ আর লিঙ্গহীন নারী শিল্পকলার কাছাকাছি।
কবিকে হ’তে হবে ব্যাকরণবিদ, ব্যাকরণবিদ নয় ব’লে বাঙলার কবিরা কবি নয়, কবিয়াল।
উপন্যাস রক্তমাংস, তাই উপন্যাস শিল্পকলা নয়।
চিত্রকলা, চলচ্চিত্র শিল্পকলা নয়; ওগুলো জনগণ চোখ দিয়ে দেখে কামে লিপ্ত হয়, ওগুলোতে কোনো কল্পনা নেই।
সঙ্গীত স্থূলদের শিল্পকলা।
মানুষ আজো কোনো বিশুদ্ধ বই লিখতে পারে নি; কোনোদিন পারবে না, যেহেতু মানুষ রক্তমাংস, অর্থাৎ অশুদ্ধ।
এমন কয়েক শো উক্তি সে লেখে। কয়েক মাসে।
স্বতঃস্ফুর্ত ঝরনাধারাও শুকিয়ে আসছে, তার ইচ্ছে হয় একটি বিশুদ্ধ উপন্যাস লিখতে–বিশুদ্ধ উপন্যাস, উপন্যাসের ইতিহাসে প্রথম ও শেষ বিশুদ্ধ উপন্যাস। বাঙলা উপন্যাস হচ্ছে শিশুদের জন্যে লেখা রূপকথা, পচা রক্ত পচা মাংসে ভরপুর; তাই এগুলো শিল্পকলা নয়; বঙ্কিম, শরৎ, তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতি শিল্পকলা নয়, স্থূলতা। কিন্তু বিশুদ্ধ উপন্যাস কী হ’তে পারে? যে-উপন্যাস বাস্তবতা থেকে যতো দূরবর্তী সেটি ততো বিশুদ্ধ উপন্যাস? বাস্তবতা হচ্ছে অবিশুদ্ধতা, বিশুদ্ধ উপন্যাসের কাজ বাস্তবতাকে ভেঙেচুরে নতুন শৈল্পিক বাস্তবতা সৃষ্টি করা, যা উঠে আসবে লেখকের মনোলোক থেকে। বিশুদ্ধ উপন্যাস দাঁড়িয়ে থাকবে কার ওপর? কাহিনীর ওপর নয়, চরিত্রের ওপর নয়, সমাজের ওপর নয়, নৈতিকতার ওপর নয়, সুখদুঃখ আশা আকাঙ্ক্ষার ওপর নয়; বিশুদ্ধ উপন্যাস দাঁড়িয়ে থাকবে শুধু নিজের শিল্পশুদ্ধতার ওপর। বিশুদ্ধ উপন্যাস পাঠকের জন্যে নয়, লেখকের জন্যে। পাঠক আফিম চায়, বিশুদ্ধ উপন্যাস আফিমের বিপরীত। হাসান আবার কয়েকটি তথাকথিত প্রধান বাঙলা উপন্যাস পড়ে, হো হো ক’রে হাসে। তারা বাস্তবতার পুজো করতে গিয়ে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন বাস্তবতাকে; কী ক’রে তারা ভাঙবেন বাস্তবতাকে, যেখানে বাস্তবতা তাদের পিতার মতো দাঁড়িয়ে আছেন তাদের সামনে? পিতার সামনে ভয় পাচ্ছেন তারা, কাঁপছেন পাঠশালার ছাত্রের মতো। বিশুদ্ধ উপন্যাস হবে বাস্তবতার বিপরীত, কবিতারই ভিন্নরূপ। হাসান একটি বিশুদ্ধ উপন্যাস লেখা শুরু করে; প্রথম পঁচিশ পাতা জুড়ে সে যা লেখে তাতে কোনো চরিত্র নেই, কোনো ঘটনা নেই, সংলাপ নেই; কিন্তু তারপরই সে দেখে উপন্যাসে তার অগোচরে রক্তমাংস ঢুকে গেছে, উপন্যাস অশুদ্ধ হয়ে গেছে; সে পাতাগুলো ছিঁড়ে বাস্কেটে ফেলে দেয়; এবং আবার লেখা শুরু করে, একটা সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে জোয়ারের জল বয়ে চলেছে, বৃষ্টি হচ্ছে, কয়েকটি কইমাছ গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে ঘাসের ওপর দিয়ে, একটি বালক ওই দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টির মধ্যে—এ-বর্ণনা লিখতে লিখতে সে দেখে দুশো পাতা, আর কয়েক মাস, পেরিয়ে গেছে সে। তখন কবিতা এসে কড়া নাড়ে; সে উপন্যাসের কথা ভুলে যায়, কবিতা লিখতে শুরু করে।
কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থ, নিঃসঙ্গতা এবং আশ্চর্য সুখ ও অসুখের ভেতর দিয়ে কেটে যায়। তার জীবনের দুটি বছর- অতিশয় দীর্ঘ, চল্লিশ হয়ে ওঠে হাসান। বিচ্ছিন্ন, বিচ্ছিন্ন, একলা, একলা, নিঃসঙ্গ, নিঃসঙ্গতম থাকতে হবে আমাকে; কেঁপে উঠলে চলবে না। কোনো মানবিক কাতরতায়; কাম নয় প্রেম নয়, শুধু অপূর্ব অন্তরঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও কবিতা, আর তুচ্ছ জীবিকার মধ্যে অতিবাহিত হবে; কাউকে ডাকবো না, কারো জন্যে ভেতর থেকে ডাক উঠবে না, সাড়া দেবো না কারো ডাকে, ভেতর থেকে সাড়া জাগাবে না, শুধু কবিতার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি আর ধ্বংস ক’রে চলবো নিজেকে, শুধু সৃষ্টি আর ধ্বংসের শিল্পকলা-এ-বোধের ভেতর দিয়ে কাটিয়ে দেয় সে নিজেকে। তার কল্পলোক, বাল্যকাল থেকেই, স্থির হয়ে আছে একটি বিশাল নিবিড় আকাশছোঁয়া বৃক্ষ, হয়তো বট হয়তো তমাল হয়তো এমন বৃক্ষ যা সে কখনো দেখে নি। শুধু সেটির স্বপ্ন দেখেছে, যার মূলে যার ছায়ায় চোখ বন্ধ ক’রে অন্ধ হয়ে নগ্ন লক্ষ লক্ষ বছর ব’সে থাকার সাধ জাগতো তার, এ দু-বছর কল্পনায় সে দিনের পর দিন রাতের পর রাত নগ্ন ব’সে থেকেছে সেই নিবিড় বৃক্ষের মূলে। অ্যান্ড ২০০০–এ সে কারো সাথে টেলিফোনে কথা বলেছে, বা কোনো তরুণ স্ক্রিপ্ট লেখককে পরামর্শ দিয়েছে, বারে কোনো বন্ধুর সাথে বিয়ার খেয়েছে আট দশ ক্যান, ফরাশি মদ খেয়েছে, তখনও তার মনে হয়েছে সে নগ্ন ব’সে আছে কোনো আকাশঢাকা বােধিবৃক্ষের মূলদেশে, তার কোনো চোখ নেই, অন্ধ সে, কিন্তু দেখছে সব কিছু। প্রচুর মাংসের মধ্যে থেকেছি। আমি, আর রক্তমাংসের মধ্যে থাকবো না, মাংসে ঘেন্না ধ’রে গেছে, মাংস নোংরা, মাংস ক্লান্তিকর, মাংস গলিত, লালাক্তি- যখনই কোনো সুন্দর মাংসের অবয়ব তাকে ডেকেছে, মনে মনে সে আবৃত্তি করেছে। এ-শ্লোক, দূরে থেকেছে মাংস থেকে। কিন্তু চল্লিশ পেরিয়ে একচল্লিশে পড়ার পর একটি অপূর্ব অবয়ব তাকে আলোড়িত ক’রে তোলে।