তিনি কি জানতেন না। আমাদের সম্পর্ক? তিনি জানতেন, কিন্তু কোনোদিন আমাকে জানতে দেন নি। তিনি জানতেন। তিনি তাঁর ধরনে সৎ ছিলেন।
তার সততা আর আমার সততা বিপরীত; আজ আমাদের বিপরীত সততার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে গেলো, ভেঙে পড়লো সব কিছু।
প্ৰত্যেককে তার নিজের ধরনের সততা নিয়ে বাঁচা উচিত? একজনের সততা চাপিয়ে দেয়া উচিত নয় আরেকজনের সততার ওপর?
আমি অপরাধ করেছি? শ্যামলীর কাছে? ফরহাদ হোসেনের কাছে?
আমি কি অপরাধ করেছি আমার কাছে?
আমি কি সৎ হয়েছি? আমি কি সুখী হয়েছি? আমি কি শান্তি পাচ্ছি?
হাসান, এর পরও কি তুমি কবিতা লিখতে পারবে? কবিতা আমাকে লিখতে হবে। সব ধ্বংস হয়ে গেলেও কবিতা লিখতে হবে; কবিতা লেখার জন্যে আমি দণ্ডিত।
সততার দণ্ডও তোমাকে পেতে হবে, হাসান।
গভীর রাতে হাসানের টেলিফোন বেজে ওঠে, হাসান ধ’রেই শোনে, এই শালা বাস্টার্ড, খানকির পো, তরে সাবধান কইর্যা দিতেছি, আমার ওয়াইফের লগে তুই মিশবি না; তার মার লগে গিয়া শো।
হাসান কিছু বলার আগেই ওপাশে একটি প্রচণ্ড চিৎকার ওঠে, মনে হয় লাথি মেরে ফরহাদ হোসেন শ্যামলীকে মেঝেতে বা খাটের কোনায় ফেলে দিয়েছেন।
হাসান বলে, আপনি শ্যামলীকে মারবেন না।
ফরহাদ খান বলেন, ওই খানকিরে আমি মারুম তর কি? পাইলে তরও হাড্ডি গুরা কইর্যা ফেলুম।
হাসান বলে, শ্যামলীকে দিন, আমি তার সাথে কথা বলবো।
ফরহাদ খান বলেন, তুই আর শ্যামলীর লগে মিশবি না। দুইটারেই খুন কইর্যা ফেলুম।
হাসান বলে, শ্যামলী চাইলে তাকে আমি নিয়ে আসবো, খুনকে ভয় করবো না।
ফরহাদ খান বলেন, ওই খানকি আর তর লগে মিশবো না।
হাসান ওই পাশে শ্যামলীর চিৎকার শুনতে পায়। ফরহাদ খান টেলিফোন রেখে দেন; হাসান বারবার ফোন করে, ফোন বাজে না।
কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ১৫
কবিতা কি ছেড়ে যাচ্ছে তাকে? বেশ কয়েক মাস হাসান কবিতা লিখতে গিয়ে শুধুই কাটাকুটি করে, ভেতরে কিছুই রূপায়িত হয় না, সেগুলো বাস্তবায়িত করতে গেলে দেখে শুধুই জীর্ণতা; সে পাতার পর পাতা ছিঁড়ে ফেলতে থাকে, ছেঁড়ার শব্দটা বিস্ফোরণের মতো মনে হয়, যেনো সব কিছু কেঁপে উঠছে, শেষে ছিঁড়ে না ফেলে রেখে দেয়–এই আক্রান্ত পাতাগুলো আমার এ-সময়ের ইতিহাস আমার জীবনী; কবিতা লিখতে না পেরে বাঙলা কবিতার সীমাবদ্ধতা পদ্যতা গদ্যতা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধের খসড়া তৈরি করে সে, কিন্তু প্ৰবন্ধটি কখনো লিখে ওঠে না; তার ক্ষুধা জাগে এমন একটি বই পড়তে, যা সমাজ নয় জীবন নয় রাজনীতি নয় নৈতিকতা নয়। দুঃখ নয় সুখ নয়, যা শুধুই সাহিত্য শুধুই শিল্পকলা; এমন একটি বইয়ের জন্যে সে বইয়ের দোকানে দোকানো যেতে থাকে, কোনো ভাষায়ই এমন কোনো বই নেই, যা বিশুদ্ধ এবং যা সে পড়তে পারে। ভাষার মধ্যেই কি রয়েছে কোনো অবিশুদ্ধতা, ভাষাই কি বিশুদ্ধতার বিরোধী? অনির্বাচন নিঃশব্দতাই শুধু বিশুদ্ধ? বাস্তবায়ন অবিশুদ্ধ? সে কি পড়বে। নিঃশব্দতাকে? না কি জীবনই অবিশুদ্ধ? জীবনের কোনো উপস্থাপনের পক্ষে বিশুদ্ধ হওয়া অসম্ভব? মুদ্রিত কিছুই পড়ার যোগ্য নয়, কিছুই বিশুদ্ধ নয়- সবই জীবনের রক্তে মাংসে পুঁজে ক্লেদে বোঝাই; তাকে এসব থেকে দূরে থাকতে হবে, সে এমন কিছু চায় যা বিশুদ্ধ শিল্পকলা। তার ইচ্ছে হয় বিশুদ্ধ গণিত পড়তে, কিন্তু হায়, গণিত তার জগতের বাইরে, সে ওই বিশুদ্ধতার বাইরে।
তার মনে দিনের পর দিন উড়তে ভাসতে কাঁপতে জ্বলতে থাকে ছেঁড়াছেঁড়া ভাবনা। এগুলো কী উড়ছে? কী ভাসছে? কী কাঁপছে? কী জ্বলছে? কী দেখা দিচ্ছে তার ভেতর থেকে? কখনো তার মনে হয় চমৎকার, কখনো মনে হয় দুঃস্বপ্নের উড়ন্ত এলোমেলো তত্ত্বজাল, যা আকাশ ভরে উড়ছে। তার ভেতরটা কি সুস্থ নেই? তার ভেতরে একটি ন্যাংটো পাগল মনের সুখে গান গাইছে? বাইরে তো সে বেশ আছে; প্রচুর অ্যাড সংগ্ৰহ ক’রে ফেলছে। অ্যান্ড ২০০০-এর জন্যে, তার ফোনে এখন কাজ হয়, সে এখন দায়িত্বশীল প্রাজ্ঞ ব্যবস্থাপক, পরামর্শ দিচ্ছে সে বিজ্ঞের মতো; কিন্তু তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এ কী দুঃস্বপ্নগ্ৰস্ত অসহ্য ঝরনাধারা বিষাক্ত অমৃতস্রোত? না, সে আয়নায় নিজের সুখ চিনতে পারে, অচেনা মনে হয় না; আয়নায় নিজের মুখ দেখে সালাম দেয় না; না, তার মগজটি এলোমেলো হয়ে যায় নি; নিজের নাম তার মনে আছে, এমন কি পিতার নামটিও সে মনে করতে পারে। সে কি এগুলো লিখে ফেলবে? যখন কবিতা আসছে না, এগুলো কি তখনকার কবিতা? এগুলো লিখে ফেলা কি ঠিক হবে? বাঙলার কৃষকসমাজ কি এগুলো মেনে নেবে? কৃষকরা তো সব সময় পবিত্র জিনিশ চায়, মহৎ জিনিশ চায়, এগুলো তো তেমন পবিত্র নয় মহৎ নয়।
তার মনে যা আসে তাই একটি দুটি বাক্যে লিখে রাখতে শুরু করে সে।
এক সুন্দর পাগলামো তাকে পেয়ে বসে। টুকরো টুকরো বাক্য, ছেঁড়াছেঁড়া কথা তাকে না জানিয়েই ভেতর থেকে উঠে আসছে, না ভেবেই সে লিখে ফেলছে, প’ড়ে দেখছে না কী লিখছে। এগুলোর কী নাম দেয়া যায়? ‘ছেঁড়াছেঁড়া দুঃস্বপ্ন’? ‘শিল্পকলার পরাদর্শন’? ‘কবির মত্ত নন্দনতত্ত্ব’? ‘হাসান রশিদের উন্মত্ততাসমগ্র’? কী নাম দেয়া যায়?
সে এগুলোর নাম দেয় ‘স্বতঃস্ফুর্ত ঝরনাধারা’। এগুলোর জন্যে একদিন সে নিন্দিত হবে নিশ্চয়ই; আদিগন্ত মূর্খ পিউবিক হেয়ার ড্রেসারগুলো— তিন অক্ষরের পিএইচডিগুলো একদিন বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখতে থাকবে হাসান রশিদ জীবনবিরোধী ছিলেন, কবি আব্বদুল আল্লির মতো তিনি জীবনমুখি ছিলেন না; হাসান রশিদ তাই নিন্দারযোগ্য।