শ্যামলী বলে, আমাদের সম্পর্ক সৎ পরস্পরের প্রতি আমরা সৎ।
হাসান বলে, না, না, আমরা সৎ নাই; পরস্পরের প্রতি আমরা সৎ নই।
হাসান একটি সিগারেট ধরায়, সিগারেটের ধুয়ো আটকে যেতে চায় তার গলায়, সিগারেট কি ছেড়ে দিতে হবে?–সে সিগারেটটি ছাইদানিতে চেপে রেখে টেলিফোন করতে শুরু করে, সিগারেট নেভে না।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, তুমি কাকে ফোন করছো?
হাসান বলে, মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন খান সাহেবকে।
শ্যামলী চমকে লাফিয়ে উঠে হাসানের হাত ধ’রে ফেলে, এবং বলে, না, না, তুমি এখন ফরহাদ সাহেবকে ফোন করতে পারো না, তুমি তাকে ফোন করতে পারো না, তুমি তাকে ফোন করো না।
হাসান বলে, আমি সৎ হ’তে চাই।
শ্যামলী হাসানের হাত থেকে রিসিভার টেনে নিতে চায়, পারে না, আবার চেষ্টা করে, পারে না; সে চিৎকার করে, তুমি তাকে ফোন কোরো না; একটা বড়ো বিপর্যয় ঘটে যাবে, তুমি তাকে ফোন কোরো না।
হাসান বলে, বিপর্যয়ের মধ্যেই তো আমরা আছি।
শ্যামলী বলে, না, তুমি ফোন করলে বিপর্যয় শুরু হবে, আমি ধ্বংস হয়ে যাবো, আমি শেষ হয়ে যাবো।
হাসান বলে, তুমি এতো ভয় পাচ্ছে কেনো? ভয়ের কিছু নেই, তার সাথে কথা ব’লে আমি সৎ হ’তে চাই; আমাদের সম্পর্ককে সৎ করতে চাই।
শ্যামলী বলে, তুমি জানো না, এতে আমার বিয়ে ভেঙে যাবে, আমার বিপদের শেষ থাকবে না।
হাসান বলে, অসৎ বিয়ের থেকে সৎ ভেঙে যাওয়া অনেক ভালো, শ্যামলী; এসো আমরা সৎ হই পরস্পরের প্রতি।
শ্যামলী বলে, আমি বিয়ে ভাঙতে চাই না, অসৎ হ’লেও আমি বিয়ে টিকিয়ে রাখতে চাই।
হাসান বলে, আমি অসততায় থাকতে চাই না, আমি ম’রে যাচ্ছি।
শ্যামলী কেঁদে ওঠে, চুলে মুখ ঢেকে নগ্ন সে মেঝেতে বসে পড়ে।
ওই দিকে কে যেনো টেলিফোন ধরেছে–কর্কশ কণ্ঠে হ্যাঁলো, হ্যাঁলো বলছে।
হাসান বলে, আমি হাসান রশিদ বলছি, আমি একটু মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন খানের সাথে কথা বলতে চাই।
শ্যামলী নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।
লোকটি বলে, বাস্টার্ড, তুই আমারে ফোন করছিছ ক্যান?
হাসান বলে, আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো।
ফরহাদ খান বলেন, তুই হারামজাদা আমার লাইফটারে হেল কইর্যা দিচ্ছ, বাস্টার্ড, আই সাফার্ড এ লট ফর ইউ।
হাঁটুর ওপর মাথা রেখে নগ্ন শ্যামলী নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।
হাসান বলে, আমি সৎ হ’তে চাই, তাই আপনাকে ফোন করেছি।
ফরহাদ খান বলেন, ইউ বাস্টার্ড, তুই চাছ সৎ হইতে, ইউ আর এ ডিজঅনেস্ট বাস্টার্ড, আই শ্যাল কিল ইউ।
হাসান বলে, আপনি জানেন আপনার স্ত্রী শ্যামলী আপনাকে ভালোবাসে না?
ফরহাদ হাসান বলেন, বাস্টার্ড, সেইটা তর লগে আমি আলাপ করুম ক্যান?
হাসান বলে, আপনি জানেন শ্যামলী আমাকে ভালোবাসে?
ফরহাদ খান বলেন, ইউ বাস্টার্ড, আই শ্যাল টিচ ইউ এ গুড লেসন।
শ্যামলী স্তব্ধ হয়ে বসে আছে; সে কিছু দেখছে না। সে কিছু শুনছে না।
হাসান বলে, দশ বছর আগেই আমার উচিত ছিলো আপনার সাথে কথা বলা, কিন্তু তখন আমি সৎ ছিলাম না, এখন আমি সৎ হ’তে চাই।
ফরহাদ খান বলেন, তর সৎ হওয়া আমি তর পাছা দিয়ে ঢুকাই দিমু।
হাসান বলে, শ্যামলী আমার সাথেই থাকবে।
ফরহাদ খান বলেন, শ্যামলী আমার ওয়াইফ, সে তার লগে থাকবো ক্যানরে হারামজাদা?
ফরহাদ খান ফোন রেখে দেন; কিন্তু হাসান বলতে থাকে, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি সৎ হতে চাই, আমি সৎ হতে চাই; তাই আপনাকে ফোন করেছি, আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি।
শ্যামলী উঠে দাঁড়ায়, নিঃশব্দে কাপড় পরে।
হাসান বলে, এখন আমরা সৎ, আমাদের সম্পর্ক সৎ।
শ্যামলী বলে, তুমি একটা শয়তান।
হাসান বলে, আমি শয়তান ছিলাম, শ্যামলী, এখন আমি সৎ, দেবতাদের থেকেও সৎ। তুমি একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে।
শ্যামলী বলে, তুমি আমার সংসারটা নষ্ট ক’রে দিলে।
হাসান বলে, তুমি এখানে থাকো, আমরা সৎভাবে ভালোবাসবো।
শ্যামলী বলে, তোমার সাথে আমি থাকতে পারি না, তোমার ভালোবাসা আমার লাগবে না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
শ্যামলী বলে, আমার সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে।
হাসান বলে, আমরা আজ অসততা থেকে মুক্ত হলাম। আমার ভালো লাগছে আমি আর অসৎ নাই, আমি সৎ হ’তে পেরেছি।
শ্যামলী একদলা থুতু ছুড়ে দেয় হাসানের দিকে; হাসান বিস্মিত হয়।
শ্যামলী বলে, তোমার এই প্রাপ্য।
হাসান বলে, সততার জন্যে আমি যে-কোনো দণ্ড মেনে নিতে পারি, শ্যামলী; সততার জন্যে শাস্তি অবধারিত।
শ্যামলী একটি চায়ের কাপ তুলে ছুঁড়ে মারে হাসানের দিকে, লাগে না; কাপটি দেয়ালে লেগে চুরমার হয়ে যায়। শ্যামলী টেলিফোন সেটটি তুলে ছুঁড়ে মারে, শেল্ফ থেকে কয়েকটি কবিতার বই নিয়ে টেনে টেনে ছেঁড়ে, ঠেলে টেলিভিশনটি ফেলে দেয়, এবং ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে ব’সে পড়ে।
হাসান বলে, এই ফরাশি কাপ আর টেলিভিশন ভাঙা কিছু নয়, আমরা এসবের থেকে আরো বড়ো কিছু ভাঙছি।
শ্যামলী উঠে হাসানের দিকে না তাকিয়ে ধীরেধীরে বের হয়ে যায়।
হাসান কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে; তার নিজেকে শূন্য লাগে না পূর্ণ লাগে না, সুখী লাগে না, অসুখী লাগে না, জীবিত মনে হয় না মৃত মনে হয় না।
আমি কি সত্যিই সৎ হলাম? না কি আরো অসৎ হয়ে উঠলাম। আমি?
মানুষের পক্ষে কি সৎ হওয়া সম্ভব? সততা কাকে বলে?
মোহাম্মদ ফরহাদ খানকে আমাদের সম্পর্ক জানিয়ে দেয়া কি সততা?