কয়েকটি দিনে হাসান একগুচ্ছকবিতা লিখে ওঠে; একটির পর একটি কবিতা আসতে থাকে, সে লেখে। এমন স্রোত অনেক দিন আসে নি; সে স্রোতে নিজেকে
প্রতিটি সরল পংক্তি ভ’রে আছে জটিল যন্ত্রণায়। আমি তো সরল পংক্তিতে সরল কবিতা লিখতে চাই, সুখ লিখতে চাই; কিন্তু আমি যন্ত্রণা লিখছি কেনো?
আমার উক্তি ও উপলব্ধির মধ্যে কি অভেদ ঘটছে না? তাই তো মনে হচ্ছে, সরল পংক্তিতে সরল সুখ আসছে না কেনো?
আমি সৎ হয়ে উঠতে চাই, আন্তরিক হতে চাই। আমি কি সৎ হয়ে উঠছি, আন্তরিক হয়ে উঠছি? সততা সততা আন্তরিকতা আন্তরিকতা কবিতা কবিতা।
এখন থেকে আমার কবিতা হবে সততার কবিতা, আন্তরিকতার কবিতা।
আগে কি আমি ছিলাম না সৎ, ছিলাম না আন্তরিক?
ছিলাম, কিন্তু দ্বিধা ছিলো, একটা দ্বিধা ছিলো, দ্বিধা ছিলো।
এখন আমি অনেক বেশি সৎ, অনেক বেশি আন্তরিক।
কিন্তু জীবনে কি আমি সৎ হ’তে পেরেছি, আন্তরিক হ’তে পেরেছি?
শ্যামলীর সাথে আমার সম্পর্ক কি সৎ, শ্যামলীর সাথে আমার সম্পর্ক কি আন্তরিক?
জীবন সততার স্থল নয়? আন্তরিকতার অঞ্চল নয়? জীবন শুধুই অসততা? অনান্তরিকতা?
জীবনে সৎ হ’লে বিপর্যয় ঘটে? তাই থাকতে হয় অসৎ?
শ্যামলীকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে, তার সাথে একটি দুপুরই তো আমার অনন্তকাল, সে-ই তো আমাকে জীবনের সম্পদ দিয়েছে, কিন্তু তার ডাকে আমি সাড়া দিচ্ছি না? কেনো? আমার ভেতর সাড়া জাগছে না কেনো? এক সময় তো আমি সাড়া দিতাম যেমন ঘাস সাড়া দেয় বৃষ্টির ছোঁয়ায়, নদী সাড়া দেয় জোয়ারে; আজ কি আমি ঘাস নই, নদী নই? শ্যামলীর সাথে কি আমি ছিন্ন হ’তে চাই? ছিন্ন হ’লে আমার কী থাকে? গুচ্ছগুচ্ছ কবিতা যে আমার ভেতরে জন্মেছে শ্যামলীর পায়ের শব্দে, জন্মেছে তার গালের আলোতে, সেগুলো কি ব্যথিত হবে না? আর আমার সেই আশ্চর্য ক্ষুধা, তার আশ্চর্য খাদ্য তো জুগিয়েছে সে-ই। তার থেকে ছিন্ন হ’লে কী থাকে আমার? থাকি আমি? কিন্তু সৎ যে আমাকে হ’তে হবে কবিতার প্রতি সৎ জীবনের প্রতি সৎ প্রেমের প্রতি সৎ।
কয়েক দিন ধ’রেই শ্যামলী একটি দুপুর চাচ্ছে, মাত্র একটি দুপুর।
হাসান বলছে, শুধু একটি দুপুর কেনো? সারাদিন নয় কেনো? সারারাত নয় কেনো? সারা বছর নয় কেনো? সারা জীবন নয় কেনো? সারা মৃত্যু নয় কেনো?
শ্যামলী বলছে, আমার সমস্যা তুমি জানো, তারপরও আমাকে বিব্রত করো। আমাকে বিব্রত ক’রে তুমি কী সুখ পাও?
হাসান বলছে তুমি তো মনে করো তুমি আমার স্ত্রী।
শ্যামলী বলছে, হ্যাঁ, তা তো মনে করিই।
হাসান বলছে, তাহলে তোমাকে সারাদিন, সারারাত, সারা জীবনের জন্য ডাকবো না কেনো?
শ্যামলী বলছে, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো; আমি সত্যিই মনে করি আমি তোমার স্ত্রী তুমি আমার হাজব্যান্ড।
হাসান বলছে, আমি যে একটি স্ত্রীর জন্যে পাগল, তা নয়। হাজব্যান্ড হওয়ার জন্যে আমি যে ব্যগ্র, তাও নয়।
শ্যামলী বলছে, তাহলে তো সব ঠিক আছে, আমি তোমার আছি তুমি আমার আছো, কোনো সমস্যা নেই।
হাসান বলছে না, সব ঠিক নেই; আমার মনে হচ্ছে সব ঠিক নেই।
শ্যামলী বলছে, কেনো ঠিক থাকবে না? আমি তো তোমার প্রতি সৎ, তোমার প্রতি ফেইথফুল, আমি অনেস্ট।
হাসান বলছে, না, আমরা সৎ নই।
শ্যামলী বলছে, না, আমরা সৎ, আমরা দুজনেই সৎ।
হাসান বলছে, তাহলে আমরা সততা কাকে বলে জানি না।
শ্যামলী বলছে, দুপুরে আমি আসবো।
হাসান বলছে, আসার কোনো দরকার নেই।
শ্যামলী বলছে, তুমি থাকবে, তুমি না থাকলে আমি তোমার দরোজার সামনে কুকুরের মতো শুয়ে থাকবো।
হাসান বলছে, তা তুমি পারবে না।
দুপুরে কি হাসান থাকবে? থেকে কী হবে? এর চেয়ে অনেক ভালো অ্যান্ড ২০০০এ গিয়ে স্পন্সরদের সাথে কথা বলা, অধস্তনদের পরামর্শ দেয়া, দু-একটি মাংসল মডেলের সাথে নিরর্থক দার্শনিক আলাপ করা। ওই মাংসল মেয়েগুলো দর্শন খুব পছন্দ করে; ওরা অবাক হয়, ওরাও মাংসে স্তনে ঠোঁটে ক্লান্ত; আত্মহত্যার দর্শন শুনতে ওদেরও ভালো লাগে। কিন্তু হাসান বেরোতে পারে না, বেরোনোর জন্যে পোশাকটোশাক প’রে আবার খুলে ফেলে; টেলিফোনে জানিয়ে দেয় দুপুরে সে আসবে না, আসবে সন্ধ্যায়।
দুপুরে শ্যামলী আসে; তারা এক সাথে খায় এবং ঘুমোয়। ঘুম শব্দটির অর্থ বদলে গেছে, অভিধানে একদিন নতুন অর্থটি মিলবে; প্রতিমুহুর্তে প্রতিটি রক্তকণিকার জেগে থাকার নাম হচ্ছে ঘুম। ঘুমের পর তারা গড়াচ্ছে, শ্যামলীর একটি হাত প’ড়ে আছে হাসানের বুকের ওপর, হাসানের একটি পা পড়ে আছে শ্যামলীর দু-পায়ের ভেতরে।
শ্যামলী বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার শরীর তোমার শরীরকে ভালোবাসে, আমার হৃদয় তোমার হৃদয়কে ভালোবাসে।
হাসান বলে, শরীর আর প্রেম আর হৃদয় আমাকে ক্লান্ত করছে।
শ্যামলী বলে, কেনো ক্লান্ত হবে? আমি কি সুখকর নাই?
হাসান বলে, আমি সম্ভবত শরীর থেকে মুক্তি চাই প্রেম থেকে মুক্তি চাই।
শ্যামলী বলে, কিন্তু একটু আগে আমরা যে সুখে ছিলাম, তাতে তো মনে হয় না তুমি শরীর থেকে মুক্তি চাও প্রেম থেকে মুক্তি চাও।
হাসান বলে, শ্যামলী, আমি সৎ হতে চাই।
শ্যামলী বলে, তুমি তো সৎ আছেই, তোমার থেকে সৎ কে আছে?
হাসান বলে, আমার মনে হচ্ছে আমি সৎ নই।
শ্যামলী বলে, আমি জানি তুমি সৎ।
হাসান বলে, আমাদের সম্পর্ক সৎ নয়; আমরা পরস্পরের প্রতি সৎ নই।