পাঁচদিন পর সন্ধ্যায় সে কাজের মেয়েটিকে নিয়ে ক্লিনিকে উপস্থিত হয়।
ডাক্তার মেয়েটি বেশ স্বাস্থ্যবতী, তাকে দেখেই বিশ্বাস হয় সে পারবে, সে নির্বাণ দিতে পারবে; তার হাত টেনে বের ক’রে ফেলতে পারবে সব কিছু।
ডাক্তার মেয়েটি বলে, আপনে চিন্তা করবেন না, ওয়েটিং রুমে ওয়েট করেন, পাঁচ মিনিটের ব্যাপার।
নার্সটি বলে, আপনে বইস্যা থাকেন, আপনের ওয়াইফের হইয়া গেলেই আপনেরে ডাকুম।
ওরা মেয়েটিকে নিয়ে ও-টিতে ঢুকে যায়; হাসান ওয়েটিং রুমে বসে থাকে। বেরিয়ে পড়ি, হাসানের মনে হয়, বেরিয়ে পড়ি, প্রতিটি মিনিটকে আমার একেকটি জন্ম মনে হচ্ছে, আমি জন্মচক্রে আটকে গেছি, আমি মুক্তি পাচ্ছি না, আমার নির্বাণ দরকার, বেরিয়ে পড়ি আমি।
পনেরো মিনিটে হাসান পনেরো হাজার পনেরো লক্ষ পনেরো কোটি জন্মচক্র অতিবাহিত করে; তারপরও তার জন্মচক্র থামে না।
নার্সটি দৌড়ে এসে বলে, হইয়া গ্যাছে, আপনের ওয়াইফের পাশে আসেন।
নির্বাণ, নির্বাণ। পনেরো মিনিটেই নির্বাণ লাভ হয়ে গেছে?
একটি ছোটো ঘরে হাসানকে নিয়ে যায় নার্স, দেখে মেয়েটি একটি বেডের ওপর শুয়ে থারথার ক’রে কাঁপছে, গোঙাচ্ছে।
নির্বাণ, নির্বাণ। নির্বাণদানের একটু যন্ত্রণা তো থাকবেই।
নার্স বলে, আমি যাই, আধঘণ্টার মইধ্যেই সব ঠিক হইয়া যাইবো। আপনে আপনের ওয়াইফের শরিলটা টিপ্পা দ্যান।
নির্বাণ, নির্বাণ। আমি কি নির্বাণ, পেতে পারি?
মেয়েটি গোঙাচ্ছে, থারথার ক’রে কাঁপছে, ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।
সে কি কখনো কারো শরীর টিপেছে? সে কি টিপতে পারবে? তার হাতের ছোঁয়ায় মেয়েটি যদি লাফিয়ে ওঠে? মেয়েটির শরীরের ছোঁয়ায় তার হাত যদি বমি করতে শুরু করে? হাসান মেয়েটিকে টিপতে শুরু করে–বেশ মসৃণ মেয়েটি; তার পায়ের পাতা থেকে শুরু ক’রে ওপর থেকে ওপরের দিকে টিপতে থাকে, মেয়েটির শরীর থেকে একটা থারথার কম্পন্ন ঢুকতে থাকে তার চামড়ার ভেতরে; হাসান তার পা, উরু, বুক, মুখ, হাত, পিঠ, কাঁধ ধীরেধীরে টেপে, মেয়েটি আরো থারথার কাঁপতে থাকে।
কাঁপতে কাঁপতে মেয়েটি বলে, আমারে জোরে জরাইয়া ধরেন।
জোরে ধরতে হবে মেয়েটিকে? হাসানের মনে পড়তে থাকে খালু, খালু, খালু, খালুর পোলারা। তারাও হয়তো জোরে ধ’রেই চিৎ করেছিলো তাকে, তারপর হয়তো একমিনিট দুই মিনিট। না কি ঘন্টার পর ঘণ্টা? রান্নাঘরে? বাথরুমে? বারান্দায়? বেডরুমে? মেয়েটি তখন চিৎকার ক’রে ওঠে নি কেনো? সুখ লাগছিলো? তীব্ৰ সুখ? পরম সুখ? চরম সুখ? শীৎকারে চিৎকারে অন্য রকমে থরথর করছিলো সে? চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিলো? খালুদের, খালুদের পোলাদের সে জড়িয়ে ধরেছিলো? এখন তাকে জড়িয়ে ধরতে হবে হাসানকে? হাসানের ইচ্ছে হয় মেয়েটিকে ঠেলে ফেলে বেরিয়ে যেতে; কিন্তু সে পারে না, মেয়েটিকে জোরে জড়িয়ে ধ’রে বসে থাকে, তার হাত দুটি যেনো মাংসের নয়, জংধরা লোহার, ডাইনামোর মতো কাঁপছে মেয়েটি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মেয়েটি উঠে বসে; হাসানের ইচ্ছে হচ্ছিলো মেয়েটি অনন্তকাল ধ’রে কাপুক এভাবে, তার সমস্ত সুখ অনন্তকাল ধ’রে কাঁপাক তাকে; কিন্তু যন্ত্রণাও চিরস্থায়ী নয়। নির্বাণলাভের উপায়ের খুবই উন্নতি ঘটেছে–বুদ্ধ এটা খুবই পছন্দ করতেন; জন্মজন্মান্তর লাগে না, গরু মেষ কুকুর হয়ে জন্মাতে হয় না, এক জন্মেই পরিনির্বাণ। একটু পরেই মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বেরোয় ক্লিনিক থেকে।
হাসানের ইচ্ছে হয়, মেয়েটিকে নিয়ে সে বারে গিয়ে বিয়ার খায়, মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করে, জিজ্ঞেস করে তার এখনো কষ্ট হচ্ছে কি না, ইচ্ছে হয় তার সাথে কবিতা নিয়ে কথা বলে, মেয়েটিকে একটির পর একটি কবিতা শোনায়, বদলেয়রের কবিতা মেয়েটির কেমন লাগে জিজ্ঞেস করে; কিন্তু হাসান এসব করে না, সে মেয়েটির হাতে একটি একশো টাকার নোট দিয়ে বলে, তুমি যাও, কাল থেকে আর এসো না।
মেয়েটি একবার পথে বসে পড়ে; কোনো কথা বলে না।
হাসান হাঁটতে থাকে; বেশ লাগছে তার, সে একজনকে নির্বাণ দিয়েছে, কিন্তু তাকে হাঁটতে হবে নির্বাণলাভের জন্যে। সে নির্বাণের জন্যে হাঁটছে, তখন অনেক দিন পর একটি কবিতার পংক্তি স্বপ্নের মতো আসে তার কাছে, গাছপালার অন্ধকারের ভেতর দিয়ে জোনাকির মতো আসে চিত্রকল্পের গুচ্ছ। সে হেঁটে হেঁটে মনে মনে কবিতাটি লিখতে থাকে, তাকে কয়েক মাইল হাঁটতে হবে, সে দেখতে পায় তার হাঁটার সাথে সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে শব্দ, বাক্য; পুরো কবিতাটিই লেখা হয়ে যাচ্ছে যেনো মাথার ভেতরে; এবং সে ভয় পেতে থাকে, মাথার ভেতরে লেখা এই কবিতা যখন কাগজে লিখবো, তখন এটি থাকবে তো, থাকবে তো? কবিতাটির সাথে খেলতে খেলতে সে হাঁটছে, তখন আকাশে অসংখ্য বীজ বেজে উঠতে থাকে, বিদ্যুতে ফালাফালা হয়ে যেতে থাকে আকাশের অন্ধকার, এবং আকাশ ভেঙে গ’লে উপচে বৃষ্টি নামে। এটা কী মাস? আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র? বৃষ্টির কথা মনে হ’লেই মাসের বাঙলা নামগুলো মনে পড়ে কেনো? অন্য সময় যে মনে পড়ে বিদেশি নামগুলো? পুরো শহর ভয় পেয়ে গেছে, সবাই ছুটছে, রিকশাগুলো চলছে ট্রাকের সাথে পাল্লা দিয়ে; হাসান হাঁটছে, কয়েক মিনিটেই থৈথৈ পথঘাট, বৃষ্টির কালো উজ্জ্বল আদরে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে সে, তার মনে হয়। জ্যৈষ্ঠের জোয়ার এসেছে, শহরের পথেপথে ঢুকছে জোয়ারের জল, এখনই হয়তো সামনে লাফিয়ে উঠবে একটি বোয়াল। কবিতাটি ভিজছে তার মাথার ভেতরে, একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়লো তার সামনে, এবং অনেক দিন পর তার মনে পড়লো গাছের পাতার রঙ সবুজ। অনেক দিন আমি সবুজ দেখি নি, সে একগুচ্ছ পাতা কুড়িয়ে নিয়ে বুকপকেটে রাখলো, মনে মনে বললো, সবুজ, আমার বুকের ভেতর ঢোকো। সারা শহর বৃষ্টিতে অন্ধকার হয়ে গেছে, সারা জগত বৃষ্টিতে আলোকিত হয়ে গেছে; অপূর্ব অন্ধকার ঢুকছে তার মগজে অপূর্ব আলো ঢুকছে তার মাংসে, ভেতরে ঢুকছে বীজ বিদ্যুৎ জল মেঘ। বৃষ্টির ভেতর দিয়ে জলের ওপর দিয়ে ভিজে ভিজে একটি কবিতা মাথায় নিয়ে এগোতে থাকে হাসান; সে জামা খুলে ছুড়ে দেয় রাস্তায়, ইচ্ছে হয় জিন্সটিও খুলে ফেলতে, সম্পূৰ্ণ নৈসর্গিক হয়ে যেতে, একবার হাত রাখে বেল্টে, হাত সরিয়ে নেয়, সরাসরি বৃষ্টি এসে অজস্র আঙুলে আদর করতে থাকে তার শরীর, তার মনে হয় বৃষ্টি প্রবল হয়ে উঠেছে তার বেল্ট ছিঁড়ে ফেড়ে জিপ টেনে তার জিন্স খুলে ফেলার জন্যে, তার সর্বাঙ্গ ধুয়ে দেয়ার জন্যে; ধুয়ে যাচ্ছে তার উধ্বাঙ্গের ময়লা, সজীব হয়ে উঠছে তার ত্বক, তার রক্তের ভেতরে বৃষ্টি, বৃষ্টি।