মেয়েটি বলে, আমার ত বিয়া অয় নাই।
হাসান বলে, পেট হ’তে বিয়ে লাগে না, জিনিশ ঢুকলেই পেট হয়।
মেয়েটি কেঁদে বলে, আমার জাইত গ্যাছে, ভাইজান।
হাসান জিজ্ঞেস করে, লোকটি কে?
মেয়েটি বলে, তা বোজতে পারি নাই, তিন চাইর খালুই তা করছে, খালুগো দুই পোলারাও করছে।
হাসানের প্রচণ্ড ঘেন্না লাগে; মেয়েটিকে কি সে লাথি মেরে বের ক’রে দেবে?
হাসান, ঘেন্নায় সে ভরে গেছে, জিজ্ঞেস করে, তখন তো খুব সুখ পেয়েছিলে, তখন তো কাঁদো নি।
মেয়েটি কথা বলে না; দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, বলো, সুখ পেয়েছিলে কি না?
মেয়েটি বলে, না, ভাইজান, পাই নাই।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো পাও নি? মে
য়েটি বলে, আমারে টাইন্যা ফেইল্যা কি করছে আমি বোজতে পারি নাই, খালি কষ্ট পাইছি, ব্যাদনায় প্যাট ফাইট্যা পরছে।
মেয়েটিকে আর পীড়ন করতে ইচ্ছে করে না হাসানের। সে জিজ্ঞেস করে, তুমি তাদের বলো নি?
মেয়েটি বলে, কইছি, তারা আমারে মাইর্যা খেদাই দিছে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, এখন কী করবে?
মেয়েটি কেঁদে ওঠে, মরুম, ভাইজান।
হাসান জিজ্ঞেস করে, মরতে হবে কেনো?
মেয়েটি বলে, আমারে অহন, কে জায়গা দিবো?
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি কি পেটের জিনিশটা ফেলে দিতে চাও?
মেয়েটি বলে, হ, ভাইজান, তয় কই ট্যাকা পামু, কোনহানে গিয়া ফালামু?
হাসান বলে, একটি মানুষ আসবে, তাকে তুমি ফেলে দিতে চাও?
মেয়েটি বলে, অইটা ত মানুষ হইব না, ভাইজান, অইটা জাউরা হইব; অইটারে আমি কোনহানে গিয়া ফালামু?
হাসান কি নিজেই জানে কোথায় গিয়ে ফেলতে হয়? এটা না ফেললে মরতে হবে মেয়েটিকে? পেটের ভেতর এমন ভয়ঙ্কর বস্তু ঘনীভূত হয়? জন্ম নেয় সাপ? সে কি মেয়েটিকে বাঁচাবে? কীভাবে বাঁচাবে? ওর বাঁচার কী দরকার?
হাসান বলে, তুমি একটি কাজ করতে পারো।
মেয়েটি বলে, কি কাম, ভাইজান?
হাসান বলে, রেল ইস্টেশনে গিয়ে গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো।
মেয়েটি বলে, ভাইজান, আমার বাইচা থাকতে মন লয়।
হাসান বলে, তুমি কাল এসো, দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না।
হাসান দুপুরে অফিস থেকে বেরোয়; তার মনে পড়ে আজ তার জন্মদিন, সে বেরোচ্ছে একটি জন্মকে প্রতিহত করার জন্যে, তার বেশ ভালো লাগে, জন্মে জন্মে জন্মে জন্মে দুঃখে দুঃখে দুঃখে দুঃখে পৃথিবী ভ’রে গেছে, আর জন্মের দরকার নেই, নিজেকে তার বুদ্ধ মনে হয়, সে জন্মচক্র থেকে একটি আত্মার নির্বাণ লাভের উপায় খুঁজতে বেরিয়েছে, কোনো অরণ্যে নয় মহাশহরে, উপায় তাকে বের করতেই হবে, নির্বাণ, অন্তত একজনের মহানির্বাণ, যে আসে নি তার নির্বাণ, সমস্ত দুঃখ কামনা বাসনা ক্ষুধা তৃষ্ণাহীন অপাপবিদ্ধ নির্বাণ। জন্ম এমন কি মহান ব্যাপার? জন্মই তো একমাত্র বিশুদ্ধ দুর্ঘটনা। মানুষ, করুণ মানুষ, দুর্ঘটনা ও দুঃখের সন্তান, তুমি কি জানো না সব কিছুর শ্রেষ্ঠ হচ্ছে জন্ম না নেয়া, কখনো ভ্ৰাণ না হওয়া, কিছুই না হওয়া; আর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ হচ্ছে জন্মের পরপরই ম’রে যাওয়া? রিকশা নিয়ে মগবাজার হাতিরপুল মোহাম্মদপুর গুলিস্থান আজিমপুর লালমাটিয়ার পথে পথে সে জন্ম প্রতিহত করার অ্যাড দেখতে পায়, একেকবার রিকশা থেকে নেমে পড়তে চায়, কিন্তু নেমে পড়তে পড়তে নামে না: অ্যাডগুলো সে মুগ্ধ হয়ে পড়তে থাকে, এমন অ্যাড সে কখনো লেখে নি, এমন উপকারী অ্যাড, নির্বাণলাভের অ্যাড, বুদ্ধের সক্রিয়তা দেখে সে মুগ্ধ হয়, শেষে সে একটি ক্লিনিকের সামনে নেমে পড়ে।
রিসিপশনিস্ট মেয়েটি তার দিকে গোলগোল চোখে তাকায়।
হাসান বলে, এখানে কি নির্বাণলাভের উপায় আছে?
মেয়েটি তার কথা বুঝতে পারে না, জিজ্ঞেস করে, কিসের উপায় আছে?
হাসান বলে, এমআর, এখানে কি এমআর করানো সম্ভব?
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, কবে করাইবেন? আইজই করাইতে চান?
হাসান বলে, না, আজ না।
মেয়েটি একটি ফর্ম বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এইটা ফিলাপ কইর্যা দ্যান।
কী নাম লিখবে সে মেয়েটির? সে কি তার নাম জানে? কী নাম মেয়েটির? কী নাম মেয়েটির? সে মেয়েটির নাম মনে করতে পারে না; সে কি মেয়েটির নাম কখনো শুনেছে? কিন্তু একটা নাম তো লাগবে, নাম ছাড়া তো ফর্ম পূরণ হবে না; হাসান ধীরেধীরে লেখে— শ্যামলী ফরহাদ।
হাসান অবাক হয়, এ-নামটি অনেক দিন তার মনে পড়ে নি, এইমাত্র মনে পড়লো, এবং অবলীলায় লিখে ফেললো।
স্বামী? হাসান ধীরে ধীরে লেখে–মোহাম্মদ ফরহাদ আলি।
এটা কি শ্যামলীর হাজব্যান্ডের নাম? তার কি ঠিক মনে পড়ছে না, না কি সে ইচ্ছে ক’রেই ভুলে যাচ্ছে?
ফর্মটি পূরণ ক’রে সে রিসিপশনিস্টের হাতে দেয়।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, আপনের ওয়াইফ?
হাসান বলে, হ্যাঁ।
মেয়েটি ফর্মে একরাশ লেখা লেখে, শেষ হ’লে একটা অংশ ছিঁড়ে তার হাতে দিয়ে বলে, আইজ পাঁচশ ট্যাকা লাগবো, করনের দিন তিন হাজার ট্যাকা লাগবো।
হাসান পকেট থেকে বের করে তার হাতে টাকাটা দেয়।
মেয়েটি বলে, পাঁচ দিন পর ডেট দিলাম, আপনের ওয়াইফের প্র্যাগনেন্সি রিপোর্ট লইয়া আসবেন।
পাঁচটি দিন খুব চমৎকার লাগতে থাকে হাসানের; দুটি শব্দ তার মাথার ভেতরে ঘুরে ঘুরে তাকে সুখে ভরিয়ে রাখে : বুদ্ধ, নির্বাণ। আমি বুদ্ধ, আমি নির্বাণদাতা; যেজন্মে নি, তাকে নির্বাণের উপায় বের ক’রে দিচ্ছি। আমি, তার কোনো দুঃখ থাকবে না, তাকে ঘুরতে হবে না জীবনচক্ৰে, বন্দী হবে না, সে, বন্দী হবে না। তার আত্মা, থাকবে। চিরমুক্ত; তার নির্বাণের উপায় বের করেছি। আমি, লোভ কামনা বাসনা তাকে পীড়িত করবে না, সে হবে নির্লোেভ নিষ্কাম, তাকে জন্ম দিতে হচ্ছে না, তাকে দিচ্ছি। আমি পরিনির্বাণ, জন্মের আগেই সে অর্জন করবে বুদ্ধত্ব, অর্জন করবে। শূন্যতা; সে জানবে না। ক্লান্তি জ্বর যন্ত্রণা, তাকে কোনো ব্যাধি দহন করবে না; চিরশান্তির শূন্যতায় সে থাকবে চিরপরিপূর্ণ। সে জন্ম নেবে না, সব কিছুর শ্রেষ্ঠ যা, সে তা অর্জন করবে। আমি কি এমন নির্বাণ লাভ করতে পারি, পেতে পারি চিরশূন্যতা, মহাশূন্যতা? পারি না? আমার জন্যে নির্বাণ নয়? অনির্বাণ? অনির্বাণ জন্মচক্র? দুঃখচক্র? সব কিছুর শ্ৰেষ্ঠ আমার জন্যে নয়? এমনকি দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ও নয়। আমার জন্যে?