আমি কেনো সৃষ্টি করতে পারছি না? নিষ্ফলা সময় আমার এতো শীঘ্ৰ এসে গেছে? এখনো তো কোনো অনশ্বর মুক্তো ফলাতে পারি নি, ভেতরে তো অনেক রোগ জন্মালো ময়লা ঢুকলো, কিন্তু সেগুলো ঘিরে তো সৃষ্টি হলো না সেই সৌন্দর্য, যা অক্ষয় হয়ে জ্বলজ্বল করবে। ভবিষ্যতের অন্ধকার ভ’রে। আমি কি জীবন দ্বারা আক্রান্ত, জীবন দিয়ে পর্যুদস্ত? মাছি পোকা পশু বেড়াল মানুষের জীবন দিয়ে? ওটা আমি কাউকে বকশিশ দিয়ে দিতে পারি? শিল্পকলার প্রতিপক্ষ কি জীবন? তাহ মনে হচ্ছে আমার- মাছির জীবন আছে, শিল্পকলা নেই; ওই কুকুরগণের জীবন আছে, শিল্পকলা নেই; আর মানুষও সামান্যই দাম দেয় শিল্পকলাকে, তারা চায় ভাত, জল, বিছানা, সঙ্গমের পর সঙ্গম এবং আরো সঙ্গম। আমি, এই আমি, যখনই জীবনের জন্যে বেশি ব্যাকুল হয়েছি, দূরে স’রে গেছে শিল্পকলা; কিন্তু জীবন ছাড়া কার গর্ভে জন্ম নেবে শিল্পকলার ভ্ৰাণ, বাড়বে কার জরায়ুতে, প্রসাবিত হবে কার যোনিদ্বার দিয়ে? এখন যে আমি সৃষ্টি করতে পারছি না, তার অর্থ কি এই নয় যে জীবন আমাকে আলোড়িত করছে না, জীবন আমাকে ক্ষুধার্তা করছে না? ক্ষুধা বোধ করছি না ব’লেই লিখতে পারছি না। কবিতা? আমি চমৎকার ঘুম যাচ্ছি? আমার ঘুমের ক্ষুধা নেই? আমি নিয়মিত পান করছি? আমার পানের ক্ষুধা নেই? আমি মানুষের সঙ্গ পাচ্ছি? আমার সঙ্গলাভের ক্ষুধা নেই? আমি সুস্থ আছি? আমার সুস্থ হওয়ার ক্ষুধা নেই? আমি সঙ্গম করছি? আমার সঙ্গমের ক্ষুধা নেই? কিন্তু কয়েক মাস তো হলো আমি নারী ছুঁই নি ওষ্ঠ ছুঁই নি অভ্যন্তর ছুঁই নি? তবু আমার কেনো ক্ষুধা নেই? তাই কি আমার ভেতর কবিতা নেই?
কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ১৪
ভোরে ঘুম ভেঙে হাসান বিছানায় গড়াচ্ছে, মনে মনে বলছে, আজি আটত্রিশ পূর্ণ হলো, কিন্তু কী করতে পেরেছি আমি?
আজ যদি মরে যাই, কী থাকবে? কটি পংক্তি, কটি চিত্রকল্প, কটি রূপক, কটি উপমা? কটি দীর্ঘশ্বাস? কটি চন্দ্রোদয়? কটি সূর্যাস্ত কটি কবিতা?
কিছুই থাকবে না। কিছুই ক’রে উঠতে পারি নি। ব্যর্থতা, শুধু ব্যর্থতা।
মাত্র চারটি কাব্য, দেড় শোর মতো কবিতা। ওগুলার কটি কবিতা?
একজন কবির পক্ষে লেখা সম্ভব কটি কবিতা? দশটি? একশোটি? পাঁচশো?
ব্যর্থতায় কাটিয়ে দিলাম একটি সম্পূর্ণ জীবন?
আমার জীবন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে? হ্যাঁ, আজ যদি ম’রে যাই, তাহলে এটাই আমার সম্পূর্ণ জীবন, যার অর্থ শূন্যতা।
কিন্তু আমি সত্যিই বেঁচে থাকতে চাই, কবিতা লিখতে চাই, আরো, আরো।
কিন্তু কবিতা কি আবার আসবে আমার কাছে?
হ’তে হবে সুচারুরূপে দণ্ডিত, বদমাশ? তাহলেই আসবে কবিতা?
কবিতা এখন বদমাশের জঘনেই আটকে থাকতে পছন্দ করে?
কখন আমি হবো বিশুদ্ধ দণ্ডিত, এবং কবি?
বারান্দায় কাজের মেয়েটি পড়ে গেছে, হয়তো ইচ্ছে ক’রেই হয়তো অনিচ্ছায়, এবং গোঙাচ্ছে, তার শব্দ শুনতে পায় হাসান। শব্দটি বেশ ভারিই হয়েছে, চমকে বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে। সে; গিয়ে দেখে মেয়েটি বসার চেষ্টা করছে, গোঙাচ্ছে, এবং কাঁদছে। মেয়েটিকে কি সে ধ’রে তুলবে? না; মানুষের মাঝেমঝে পতন দরকার, পতন থেকে ওঠা দরকার। হাসানকে দেখে মেয়েটি ভালোভাবে বসার চেষ্টা করছে, পারছে না। মেয়েটি মাথা নিচু ক’রে কাঁদতে থাকে। মাথা নিচু ক’রে কাঁদা হাসান পছন্দ করে না; এভাবে যারা কাঁদে তারা কাঁদতে কাঁদতে জানায় যেনো তারা পুণ্যে পরিপূর্ণ, একটুও পাপ জানে না, পাপী শুধু অন্যরা, অন্যদের জন্যেই তাদের জীবনটা শেষ হয়ে গেলো।
হাসানের ইচ্ছে হয় বলে, গেট আউট, গেট আউট, এসব কান্দাকান্দি আমার ভালো লাগে না, বেরিয়ে যাও; তবে সে তা বলতে পারে না।
মেয়েটি কোনো কথা বলে না; হাসান মেয়েটির মুখ দেখতে পায় না, কিন্তু সে বোঝে কাদঁছে মেয়েটি।
নিষ্পাপ, আহা নিষ্পাপ, পবিত্র মেরি–ঘেন্না লাগে হাসানের।
এই মেয়েটির কান্না কি গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে? কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়; অজস্র মেয়ে কাঁদছে পৃথিবীতে, সে তাদের সবাইকে কান্না থেকে মুক্তি দিতে পারে না; যার কাঁদার সময় এসেছে, সে কাঁদুক; প্রত্যেককে নিজের জন্যে নিজেকেই কাঁদতে হয়। মেয়েটি কাঁদুক, এটা তার জীবন, সে-ই যাপন করুক।
হাসান বাথরুমে ঢুকে সকালের বিরক্তিকর ক্লান্তিকর কাজগুলো করে, মেয়েটির কান্নার কথা তার মনে থাকে না, বেরিয়ে খাবার খায়, জন্মদিন উপলক্ষে টেলিফোনে তিন চারটি শুভেচ্ছা গ্ৰহণ করে, নিজেকে পরিহাস করে বুড়ো আর ব্যর্থ হওয়ার জন্যে, বেরোনোর জন্যে প্রস্তুত হয়, কিন্তু মেয়েটি তখনও বসে আছে বারান্দায়; এবং কাঁদছেও। কান্নাটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না, মেয়েটি যে যায় নি, সেটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি এখনো যাও নি?
মেয়েটি আবার কেঁদে ওঠে। হাসান কান্নার দর্শক, সে কান্নার অন্তর্ভুক্ত নয়, তার কাছে মেয়েটির কান্নাকে শিল্পিত ও অ্যাড সম্মত মনে হয় না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বলো।
মেয়েটি বলে, আমার মরতে হইবো, ভাইজান।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
মেয়েটি বলে, আমার আর ইজ্জত নাই, আমার প্যাট হইছে।
হাসান বলে, পেটে জিনিশ ঢুকলে তো পেট হবেই। কিন্তু কাঁদছো কেনো, তাতে তো আনন্দ করার কথা। বাসায় গিয়ে লালপোড়ে শাড়ি পরে হাসো।