আলাউদ্দিন রেহমান হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতে দিতে বলে, দোস্ত, তুমি মাসখানেক ঢাকার বাইরে চুপচাপ বেড়াই আসো।
আলাউদ্দিন বলে, ক্লাইমেইট একটু সফ্ট্ হইবো এইর মইধ্যে।
হাসান বলে, আমার মনে হয় কিছুই কোমল হবে না, আমরা ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর দুৰ্ঘটনার দিকে যাচ্ছি।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, আমারও সেই রকমই মনে হইতাছে।
হাসান বলে, আমি দিকে দিকে রাইফেলের নল দেখতে পাচ্ছি, লেফরাইট লেফরাইট শুনতে পাচ্ছি।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, লও, আমিও তোমার লগে বেড়াই আসি।
হাসান কি মাকে দেখতে যাবে আলাউদ্দিনকে নিয়ে? কিন্তু মায়ের মুখই তো মনে পড়ছে না। যদি সে মাকে চিনতে না পারে? মা যদি তাকে চিনতে না পারে?
কোথায় যেতে পারি আমি? আমি কি পরিচিত প্রিয়দের মুখ দেখতে চাই? আমার পরিচিত কারা? প্রিয় কারা? আমার কি কোনো পরিচিত আছে, প্রিয় আছে? মায়ের মুখ দেখলে কি সুখী হবো? মায়ের মুখটি কেমন? আমার যেতে ইচ্ছে করছে এমন কোথাও যেখানে আমাকে কেউ চেনে না, আমি কাউকে চিনি না; সেটা যদি হতো কোনো প্রাচীন আদিম অরণ্য নির্জন দ্বীপ ধুধু চর, সুখী হতাম। সুখী? আমি কি সুখী হ’তে চাই? কোথায় পাবো প্রাচীন অরণ্য? কোথায় নির্জন দ্বীপ? ধুধু চর? কেমন হয়। হাতিয়া? সন্দ্বীপ? মহেশখালি? পদ্মার চর? সেখানে কি নির্জনতা আছে? সেখানে কি মানুষহীনতা আছে? মানুষের মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না; আমি দেখতে চাই পাহাড়, বন, কুঁড়েঘর, নদীর বিষন্ন তীর, কাশবন, পালে পালে গাভীর মুখ, সবুজ ঘাসের প্রান্তর।
পদ্মার একটি চরে একটা উঁচু কুঁড়েঘরে যখন তারা সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি কাটাচ্ছিলো, এপাশে ওপাশে কাশবন দেখছিলো, হারিয়ে যাচ্ছিলো কাশফুলের শাদা মেঘের মধ্যে, কাশ ভেঙে চিবোচ্ছিলো, মোটা ভাত আর ইলিশের গানগনে ঝোল ডিম খেয়ে জিভের স্বাদ ফিরে পাচ্ছিলো, এক সন্ধ্যায় একটা ছোটো ডিঙ্গিতে দুই মাঝির সাথে ইলিশ ধরতে গিয়ে ইলিশের ধবধবে শাদা নাচ আর মৃত্যু দেখে সুখী ও কাতর হয়ে উঠছিলো, তখন তারা সংবাদটি পায়। তারা তখন সভ্যতা থেকে বহু দূরে, সভ্যতাকে তারা পায়ের ময়লার মতো ধুয়ে এসেছে; সংবাদ, অ্যাড, রাজনীতি থেকে দূরে থেকে সুস্থ হয়ে উঠছে, তখন সংবাদটি তারা পায়।
এক মাঝি তার ছোটো ট্রানজিস্টরে প্রথম সংবাদটি পায়।
মাঝি ছুটে এসে সংবাদ দেয়, ছার, দ্যাশে খুনখুনি শুরু অইয়া গেছে, সবতেরে মাইর্যা ফ্যালাইছে, সবতেরে মাইর্যা ফ্যালাইছে।
হাসানের মাথার ভেতরে তীব্ৰ অন্ধকারের ঝাকঝাক ছুরি ঢুকে যায়; সে নদী জুড়ে কলকল খলখল অন্ধকার বয়ে যেতে দেখে।
আলাউদ্দিন বলে, না, এইটা হইতে পারে না, এইটা সম্ভব না।
মাঝি বলে, না, ছার, হইছে, অন্যরা দ্যাশ দখল করছে।
আলাউদ্দিন বারবার ঘোষণা শোনে, আর বলে, না, এইটা হইতে পারে না, এইটা সম্ভব না।
হাসান অন্ধকারের কলকল খলখল শুনতে পায়, কলকল খলখল দেখতে পায়।
হাসান বলে হয়তো অসম্ভবই ঘটে গেছে কিছুই অসম্ভব নয়।
আলাউদ্দিন বলে, তাইলে এখন দ্যাশের কি হইবো?
বুটের শব্দ পাচ্ছি, দশকজোড়া বুট।
আলাউদ্দিন আর মাঝিটি ভয় পায়; হাসান বলে, আমি একটু একা থাকতে চাই, নদীর পারে একা হাঁটতে চাই।
আলাউদ্দিন বলে, সাবধানে হাইটো।
হাসান হাঁটতে থাকে, যেনো সে চোখে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু একটি বিশাল লাশ দেখতে পায়; লাশটি একবার নদী হয়ে ওঠে নদীটি একবার লাশ হয়ে ওঠে, চারটি একবার লাশ হয়ে ওঠে। লাশটি একবার চর হয়ে ওঠে।
হাসান নদীকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, এরকম কি কথা ছিলো?
হাসান চরকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, এরকম কি কথা ছিলো?
নদী আর চর শুধু তার দিকে একটি বিশাল লাশ তুলে ধরে।
অনেক দিন কবিতা লেখি নি হাসান; তার ভেতর গুঞ্জন করে নি কোনো পংক্তি, কোনো চিত্রকল্প জ্ব’লে ওঠে নি স্থির বিদ্যুতের মতো, ঝিলিক দেয় নি কোনো নাচ; মগজটাকে তার মনে হচ্ছে ঝামাপাথর, যেখানে কোনো গুলা জন্মে না, যার ভেতর দিয়ে কোনো নদী বয় না, যার ভেতরে কোনো মেঘ নেই। কিন্তু কবিতা তো লিখতে হবে তাকে–আমাকে কবিতা লিখতে হবে, আমি কবিতা লেখার জন্যে দণ্ডিত, কবিতা লেখাই আমার দণ্ড, আমি যদি এই দণ্ডকে অস্বীকার করি তাহলে অস্বীকার করি নিজেকেই, নিজের জীবনকেই। সব কিছু অস্বীকার করতে পারি। আমি, কিন্তু জীবনকে পারি না, তাই কবিতা লেখাকে অস্বীকার করতে পারি না, হয়তো জীবনকেও পারি অস্বীকার করতে, কিন্তু কবিতা লেখাকে পারি না–জানি আমি জানি এটা সিসিফাসের শ্ৰম, যে-পাথর গড়িয়ে পড়ে যাবে তাকে গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের শিখরে নেয়া; স্বেচ্ছায় আমি, আমার রক্তধারা, এই দণ্ডকে বেছে নিয়েছি, এই দণ্ডের প্রতি সৎ থাকতে হবে আমাকে। আমি জীবনের প্রতি সৎ থাকতে না পারি, জীবনকে আমি শুয়োরের খাদ্যে পরিণত করতে পারি, ঢেলে দিতে পারি নর্দমায়; কিন্তু সৎ থাকতে হবে আমার দণ্ডের প্রতি, কবিতার প্রতি, আর প্রতিটি পংক্তি, ধ্বনি, রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্পের প্রতি। কবিতার প্রতি সৎ থাকাই আমার সততা। মানুষের প্রতি মানুষের সৎ থাকা সম্ভব নয়, আমি হয়তো সৎ থাকতে পারি নি মানুষের প্রতি, আমি সৎ নই শ্যামলীর প্রতি, শ্যামলী সৎ নয় আমার প্রতি, অসততাই জীবনের দণ্ড; কিন্তু শিল্পের দণ্ড সততা, তার প্রতি আমাকে সৎ থাকতে হবে, আমাকে সৃষ্টি ক’রে যেতে হবে।