পাশ করার পর সে কয়েক বছর কাটিয়ে এসেছে সম্পূর্ণ বিপরীত এক এলাকায়, যেখানে থাকলে গাধা গরু গাড়লদেরও কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে, দু-একটি গাড়ল তাকে কবিতা লিখে দেখিয়েছেও, ওরা যে কোনো কবিতার কামড় বোধ করে, কিন্তু ওই তিন বছর সে কোনো কবিতা লেখে নি, কোনো পংক্তি এসে তাকে ধাক্কা দেয় নি। একটা চাকুরি তার দরকার হয়েছিলো–কবিরও চাকুরির দরকার হয়! ঢাকায় কিছুতেই পাচ্ছিলো না; তখন তাকে চাকুরি নিয়ে যেতে হয়েছিলো একটা প্রায় গ্রামের কলেজে।
ইন্টারভিউর পর লিকলিকে থুতুঝরা প্রিন্সিপালটি তাকে বলেছিলো, আপনেরেই সবচাইতে কম্পিটেন্ট মনে হইতেছে, আপনেই সবচাইতে ভাল করছেন, কিন্তু একটা প্ৰব্লেম হইতেছে আপনে কবিতা লেখেন।
নিজেকে খুবই দণ্ডিত মনে হয়েছিলো তখন, ঘেন্না লাগছিলো নিজেকে, কেনো যে সে আবেদনপত্রে উল্লেখ করেছিলো তার দুটি প্রবন্ধ আর কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়।
হাসান জিজ্ঞেস করেছিলো, কবিতা লিখি, তাতে কী সমস্যা?
প্রিন্সিপালটি বলেছিলো, কবিরা ক্যারেক্টারলেস অয়, খালি মাইয়ালোক লইয়া ফষ্টিনষ্টি করে। আমার কলেজে আবার মাইয়ারা পড়ে।
হাসান বলেছিলো, রবীন্দ্রনাথ নজরুলও কবি ছিলেন।
প্রিন্সিপালটি বলেছিলো, অই তাগোও ক্যারেক্টর আছিল না, তারাও খালি মাইয়ালোকের কথা বলছে, খালি প্রেমলীলার কথা।
হাসান বলেছিলো, কিন্তু তাঁরা তো মহাপুরুষ বলে গণ্য।
প্রিন্সিপালটি বলেছিলো, হ, মহাপুরুষ, মরণের পর এই কবিগুলি মহাপুরুষ হয়, বাচনের সময় অইগুলি ক্যারেক্টারলেস মানুষ। আমাদের ধর্মে বলে কবিরা মরণের পর দোজগে যাইবো।
হাসান কোনো উত্তর দেয় নি, লোকটিকে দেখছিলো; সে দেখেছে। এই নোংরা লোকটিই চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
প্রিন্সিপালটি আরো বলেছিলো, আপনেরে লইতে পারি, ইন্টারভিউ আপনে সব চাইতে ভালই দিছেন, তয় কথা দিতে হইবো কবিতা লেখতে পারবেন না, আর মাইয়া স্টুডেন্টগো লগে ফষ্টিনষ্টি করতে পারবেন না। মাইয়ালোকও যেমুন, কবি শোনালে কাইত হইয়া পড়ে, আর আপনে দেখতেও খারাপ না।
ওই তিন বছর তার বুকে কেঁপে ওঠে নি। কোনো পংক্তি, রক্তে গুঞ্জন করে নি। কোনো রঙিন শব্দ, রোদ মেঘ অন্ধকার জ্যোৎস্নালাগা দৃশ্য চােখে ঝলমল ক’রে ওঠে নি, মাংসকোষকে উত্তেজিত করে নি কোনো অভাবিত আকস্মিক তুলনা, কোনো চিত্রকল্প তাকে মত্ত প্ৰমত্ত উন্মত্ত করে নি ধ্বনিগন্ধ স্বাদস্পর্শরূপে, সে কোনো কবিতা লিখতে পারে নি, লেখে নি; গাড়ল মোষের মতো প্রিন্সিপালটির আদেশ মানার জন্যে নয়, ওই প্রথাগত সুন্দর চারপাশ তার ভেতরে কোনো কবিতা সৃষ্টি করে নি। হাসান বিস্মিত হয়ে দেখেছে চারপাশ অত্যন্ত সুন্দর; দিঘি ধানখেত তালগাছ আছে, নিবিড় সবুজ ঘন গাছে ঢাকা কয়েকটি পরিত্যক্ত হিন্দুবাড়িও আছে, নীল আকাশ, মেঘ, নিবিড় বৃষ্টি, শিশির, সরষে ফুলের হলুদ বিস্তারও আছে, কিন্তু তার ভেতর নেই কোনো কবিতা। বইপত্র পড়েছে, ছাত্রদের পড়িয়েছে যদিও ছাত্ররা পড়তে চায় নি, গদ্যপদ্য বই নিরর্থক তাদের কাছে, আড্ডা দিয়েছে, মাঝেমধ্যে ঢাকা এসেছে সে, কিন্তু কবিতা লেখে নি; তার মনে হয়েছে হাসান রশিদ থেকে সে আবার মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার হয়ে গেছে। এক মান বিকেলে তার ভেতরে হাসান রশিদ কথা ব’লে ওঠে যদি কবিতাই না হয়, কবিতাই না সৃষ্টি করো, তাহলে কী দরকার ছিলো তোমার হাসান রশিদ হওয়া, নিজেকে ভাঙা, কী দরকার ছিলো ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে গ্রামের তুচ্ছ কলেজে তুচ্ছতর বাঙলার মাস্টার হওয়া? তুমি কি এই গ্রামের কলেজে সাতটা কায়কোবাদ এমদাদ আলি পাঁচটা শহিদুল্লাহ বরকতুল্লাহ পড়ানোর জন্যে নিজেকে ভাঙা শুরু করেছিলে? তুমি না হ’তে চেয়েছিলে এমন কিছু যা গুড বয়রা কলেজের মাস্টাররা কখনো হ’তে চায় না? তুমি এখান থেকে কেটে পড়ো হাসান, ভাগো, তুমি নষ্ট হচ্ছো, কবিতা সৃষ্টি না করাই তোমার জন্যে নষ্ট হওয়া; তুমি নষ্ট হও, সম্পূর্ণ নষ্ট হও, কবিতার জন্যে, চিত্রকল্পের জন্যে; কুষ্ঠরোগী হও, দুরারোগ্য কুষ্ঠরোগী হও, কবিতার জন্যে; পাপী হও, অমোচনীয় পাপী হও, কবিতার জন্যে; তুমি দণ্ডিত হও, চিরদণ্ডিত হও, ধ্বংস হও, কবিতার জন্যে; আর কিছু নয়, তুমি শুধু কবিতার জন্যে, তুমি বিকশিত হবে শুধু কবিতার জন্যে, নষ্ট হবে শুধু কবিতার জন্যে। কবিতা তোমার জীবন, কবিতা তোমার তিলে তিলে ভয়াবহ মৃত্যু।
কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৩
পর দিনই সে কলেজকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে, গাড়ল প্রিন্সিপালটি আর তার সুস্থ স্বাস্থ্যবান সহকর্মীরা খুবই অবাক হয়।
ঢাকা, কবিতার জন্যে নষ্ট হওয়ার এই একটিই শহর রয়েছে, একটিই স্বৰ্গ একটিই নরক রয়েছে, এই একটিই অশেষ অন্ধকার একটিই অনন্ত জ্যোতি রয়েছে, একটিই সুস্থতা একটিই অসুস্থতা রয়েছে।
হাসান অনেক দিন পর এই অন্ধকারে এই জ্যোতিতে এসে ওঠে।
প্রথম একটি শস্তা হোটেলে ওঠে, এবং শিউরে ওঠে হাসান যে ট্রেন থেকে নামতেই একটি পংক্তি একটি দ্রুত ট্রেনের মতো গমগম ক’রে তার ভেতরে ঢুকে যায়, পংক্তিটিকে মাথায় আর বুকে আর রক্তে নিয়ে সে তিন চার দিন ধরে শহরের পথে পথে ঘোরে, বন্ধুদের অফিসে বিব্রতভাবে প্রবেশ করে, আড্ডা দেয়, দু-একটি পত্রিকার অফিসে যায়, এবং এক রাতে পংক্তিটি একটি সম্পূর্ণ কবিতা হয়ে কাগজে আত্মপ্রকাশ করে। তার মনে হয় এই প্রথম সে শব্দ আর বাক্য লিখলো, এই প্রথম সে শব্দকে বাক্যকে এমন রূপ দিলো, যাকে কবিতা বলা যায়।