হাসান বলে, আমি মাকে দেখতে যেতে চাই।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, এখনি?
হাসান বলে, তা জানি না।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, মায়ের মুখ তোমার মনে আছে তো, তাকে চিনতে পারবে তো?
হাসান বলে, আমার মুখ মা নিশ্চয়ই চিনতে পারবে।
শ্যামলী বলে, আমার তা মনে হয় না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
শ্যামলী বলে, আমার মনে হচ্ছে এখন আমিই হয়তো তোমার মুখ চিনতে পারবো না।
হাসান মায়ের মুখটি মনে করতে চেষ্টা করে, কিছুতেই মনে করতে পারে না; মায়ের মুখটি দেখতে ইচ্ছে করলেই ঘুরেফিরে নানা মুখ আসতে থাকে, শ্যামলীর মুখ আসে, অ্যাডের কয়েকটি মডেলের মুখ আসে, অনেক আগে মরো-যাওয়া পাশের বাড়ির এক মহিলার মুখ মনে আসে, যে একবার তার গাছ থেকে বরই পাড়ার জন্যে তাকে ‘চোরা দারোগার পো’ বলে বকেছিলো; কিন্তু মায়ের মুখটি আসে না। মায়ের মুখটি কেমন? মায়ের মুখটি কেমন? মায়ের মুখটি কেমন? সে কল্পনা করার চেষ্টা করে মা তাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে, কিন্তু মায়ের মুখ আসে না; সে কল্পনা করে মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরছে, কিন্তু মায়ের মুখ সে দেখতে পায় না; সে কল্পনা করে ইস্কুল থেকে দেরি ক’রে ফিরছে সে, আর তার মা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে তাকে দেখবে ব’লে, কিন্তু সে মায়ের মুখটি দেখতে পায় না। আমার মায়ের মুখটি কেমন ছিলো? তার গালে কি কোনো দাগ ছিলো? মারা কি জোড়া ভ্রু ছিলো? মা হাসলে কি গালে টোল পড়তো? মার চোখ দুটি কি তাদের পুকুরের মতো ছিলো? মায়ের মুখে কি একটা অমোচনীয় বিষন্নতা ছিলো? কপালে একটা দুঃখের দাগ ছিলো? তাঁর ঠোঁট কি শুকনো ছিলো, যাতে কখনো চুম্বনের ছোঁয়া লাগে নি?
হাসান জিজ্ঞেস করে, শ্যামলী, তুমি কি বলতে পারো?
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, কী, বলো?
হাসান বলে, আমার মার মুখটি দেখতে কেমন?
শ্যামলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মার চোখ কেমন?
শ্যামলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মার ঠোঁট কেমন? শ্যা
মলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মারা ভ্রু কেমন?
শ্যামলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান বলে, তুমি দেখো নি কেনো? তুমি দেখো নি কেনো? দেখো নি কেনো?
কয়েক দিন পর চারজন শক্তিমান জিন্স ট্রাউজার পাজামা পাঞ্জাবি কৃষক-শ্রমিক আসে হাসানের অফিসে; তাদের চেনে হাসান, তারাও ভালো ক’রেই চেনে হাসানকে। তারা অফিসে ঢোকার পর কলরাবিত বর্ণাঢ্য অফিসটি প্রাচীন অরণ্যের মতো নীরব নিঝুম হয়ে ওঠে, বিবর্ণ হয়ে ওঠে; মনে হয় সবাই গঙ্গার তীরে পদ্মাসনে ব’সে সমাধিমগ্ন ধ্যান করতে শুরু করেছে, চঞ্চল বালিকাদের মতো মুখর বাচাল টেলিফোনগুলোও বটগাছের নিচে সমাধিমগ্ন, দেয়ালের রূপসী মডেলটি হঠাৎ হাসি বন্ধ ক’রে টানটান দেয়াল হয়ে গেছে।
একজন বলে, আপনে শ্ৰদ্ধেয় শ্যাক শহিদালি সাহেবের সভায় যান নাই।
হাসান বলে, হ্যাঁ, আমি সাধারণত নিমন্ত্রণে যাই না।
আরেকজন বলে, ওইটা নিমন্ত্রণ ছিল? বোঝাতে পারেন নাই ওইটা অর্ডার?
হাসান বলে, না, আমি বুঝতে পারি নি।
একজন বলে, দলের অর্ডার অমান্য কইর্যা আপনে অপরাধ করছেন।
হাসান বলে, আদেশ আমার ভালো লাগে না।
আরেকজন বলে, বাচতে হইলে অক্ষরে অক্ষরে অর্ডার মানতে হইবো।
হাসান কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে বলে, বাঁচা সম্ভবত আমার হবে না।
একজন বলে, বেশি সময় আমাগো নাই, একদলে যোগ দ্যাওনের ফর্ম আমরা লাইয়া আসছি, একটা সাইন কইর্যা দ্যান সে আপনে একদলে যোগ দিলেন।
হাসান বলে, আমি তো রাজনীতি করি না, তাই আমার দলে যোগ দেয়ার তো কোনো দরকার নেই।
আরেকজন বলে, রাজনীতি আপনের করতে হইবো না, পলিটিক্স আমরাই করবো, আপনেগো কাম আমাগো সাপোর্ট করা, আমাগো নামে শ্লোগান দেওয়া।
হাসান বলে, আমি কী ক’রে স্বৈরাচারকে সমর্থনা করি?
একজন বলে, সাবধান হইয়া কথা কইয়েন, এইটা স্বৈরাচার না, এইটা গণতন্ত্র এইটা সমাজতন্ত্র, দ্যাশের জইন্যে এইটা দরকার।
আরেকজন বলে, আপনের কোনো ফিউচার নাই মনে হইতেছে, এমন করলে খরচ হইয়া যাইবেন।
একজন বলে, আমাগো টাইম নাই, তরাতিরি একটা সাইন দ্যান।
হাসান বলে, এখন সম্ভবত আমি সাইন দিতে পারবো না।
আরেকজন জিজ্ঞেস করে, কখন পারবেন?
হাসান বলে, একদিন নিশ্চয়ই পারবো, তখন আমি না করবো না, যেখানে সাইন দিতে বলবেন সেখানেই দেবো, তবে তখন হয়তো আমি থাকবো না।
তারা ওঠে, তার চেয়ারেটেবিলে লাথি মারে, বলে, মনে করেন আপনে নাই।
একটি কবিতা কয়েক দিন ধ’রে তার ভেতরে ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রজাপতির মতো, ফিরে আসছে ডানায় পরাগ মেখে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে; আজ তার ইচ্ছে করছে প্রজাপতিটি ধরতে কবিতাটি লিখে ফেলতে, নইলে হয়তো চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে; সন্ধ্যায় সে বসে কবিতাটি লিখে ফেলতে; অবাক হয় যে সে ঠিকমতো বলপেন ধরতে পারছে না। আমি কীভাবে ধরি বলপয়েন্ট, নিজেকে সে জিজ্ঞেস করে, কীভাবে ধরি? আজি ধরতে পারছি না কেনো? এতো দিন কি আমি বলপয়েন্ট ধ’রে লিখি নি? কলম ধরা কি ভুলে গেছি আমি? হাসান বলপয়েন্টের ঢাকনা খুলে পাশে রেখে বলপয়েন্ট ধরতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঠিকমতো ধরতে পারে না। আমি কি লেখার সময় ঢাকনাটা পেছনের দিকে লাগিয়ে নিই? তাতে সুবিধা হয়? পেছনের দিকে লাগিয়ে না নিলে কি আমি লিখতে পারি না? হাসান ঢাকনাটি তুলে বলপয়েন্টের পেছনে লাগিয়ে বলপয়েন্টটি ধরতে চেষ্টা করে; কিন্তু ঠিকমতো ধরতে পারে না। আমি প্রথম কীভাবে লিখতে শিখেছিলাম? একটি মাটির পেন্সিল, তার মনে পড়ে, একটি মাটির শ্লেট, চারদিকে সোনালি কাঠের ঘের, তার মনে পড়ে; বাবা তাকে পেন্সিল ধরতে শিখিয়েছিলেন, বাবার হাত কাঁপছিলো, কিন্তু তার হাত কাঁপছিলো না। সে তো শুরুতেই ঠিকমতো পেন্সিল ধরেছিলো; আজ কেনো পারছে না? আচ্ছা, বলপয়েন্টটাকে যদি আমি মাটির পেন্সিল আর ডায়েরিটাকে স্লেট মনে করি, তাহলে কি ধরতে পারবো? গোড়া থেকে শুরু করবো আবার? হাসান পারে না, তার মনে হয় কলম সে আর ধরতে পারবে না; বলপয়েন্টটিকে তার অচেনা মনে হয়। এরকম কোনো বস্তু আমি আগে কখনো ধরি নি, ধরার অভ্যাস নেই আমার, হাসানের মনে হয়, আমি লেখনি ধরতে জানি না, আমার আদিম পূর্বপুরুষ যেমন এটা ধরতে জানতো না তার মতো আমিও এটা ধরতে জানি না। এটা ভেবে তার ভালো লাগে; হাসান তাকিয়ে থাকে বলপয়েন্টটার দিকে, বলপয়েন্টটিকে তার অচেনা থেকে অচেনোতর মনে হয়, বলপয়েন্টটি একটি লিকলিকে সরীসৃপ হয়ে তার আঙুলে জড়িয়ে যেতে থাকে, তার শরীর কেঁপে ওঠে, ঝাঁকুনি দিয়ে হাসান সেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।