হাসান বলে, কোনো কথা তো আমার নেই।
মেয়েটি খিলখিল ক’রে হেসে ওঠে, কি যে কন ভাইজান, পুরুষপোলাগো, কওনের কতার অভাব আছে নি দুনিয়ায়? ক’তা না পাইলে খালুরা আমার ঠোডের আর মোখের শোভা লইয়া কত কতা কয়।
হাসান বলে, তোমার কেমন লাগে?
মেয়েটি বলে, শোনতে আমার ভালই লাগে। খালুগো মোখে বড় রস, আমারে খালুরা রসগোল্লার মতন গিলতে থাকে।
হাসান বলে, আমি তো খালু নাই।
মেয়েটি বলে, হ, হেই কথা আমি জানি, আপনে বিয়াশাদি করেন নাই, হেই লিগাই ভাইজান কইলাম, বিয়াশাদি না হইলে তো রস আরও বেশি হওনের কতা।
হাসান বলে, তোমার কি টাকা পয়সা লাগবে?
মেয়েটি বলে, হ, ভাইজান, পঞ্চাশটা ট্যাকার খুব দরকার।
বেশ ঝলমলে মেয়েটি, হাসান তাকে একটা একশো টাকার নোট দেয়। মেয়েটি টাকাটা নিতে নিতে চোখ বড়ো ক’রে বলে, ভাইজান আপনে আমার কাছে যা চাইবেন তা’আই পাইবেন, আপনেরে আমি না করুম না।
হাসান বলে, ঠিক আছে, দরকার হ’লে চাইবো।
মেয়েটি বলে, রাইতে থাকতে কইলেও থাকুম।
মেয়েটি একটি তীব্ৰ হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায়, মেয়েটিকে বেশ চমৎকার লাগে। হাসানের; কিন্তু কোনো দিন কি কিছু তার চাইতে হবে মেয়েটির কাছে?
এই বাসায় সে উঠেছে। বছর দশেক আগে; এবং এই বাসা ও এলাকাটির সাথে সে জড়িয়ে গেছে এক অবর্ণনীয় সম্পর্কে। সে এখানে থাকে। কিন্তু তার মনে হয় সে এখানে থাকে না, আবার এখানে ছাড়া অন্য কোথাও থাকার কথাও সে ভাবতে পারে না, কখনো তার মনেই হয় না। অন্য কোথাও সে থাকবে। শহরের একপাশে এই এলাকাটি, এখানে ঢোকার অনেক আগেই এর জীবনের গানগনে তাপ বাঘের মতো শরীরের সবখানে থাবা দেয়; এটি কখনো ঘুমোয় না, দুপুরে যেমন উত্তেজিত জেগে থাকে রাত চারটায়ও জেগে থাকে তীব্রভাবে, বড়ো রাস্তাটি ও গালিগুলোতে কখনো সঙ্গমে সঙ্গমে জন্মপাওয়া মানুষের অভাব হয় না, এই এলাকায় হয়তো প্রতিরাতে শ-দুয়েক নারী গর্ভবতী হয়, দোকানগুলো কখনো বন্ধ হয় না, সব সময় কেনাবেচা চলছেই। এতো কেনার আছে, এতো বেচার আছে? রিকশা, বেবি, ট্রাক, ঠেলা, ভ্যান, অন্ধ, পঙ্গু, কুণ্ঠরোগী, আর সুস্থ মানুষ সব সময় ঠেলা ঠেলি করছে; এটা এক চিরজাগ্রত এলাকা। এর প্রচণ্ড হৃৎপিণ্ড অজস্র ট্রাকের ইঞ্জিনের মতো সব সময় গর্জন করছে। এই বাড়িটার যিনি মালিক, তিনি এটি তৈরি করতে করতে এই পাঁচতলাটির মতোই নিজেকে অসম্পূর্ণ রেখে চ’লে গেছে, তার মনে হয় এমন অসম্পূর্ণ কিছুই সে খুঁজছিলো। পাঁচতলায় একটিমাত্র বিরাট ঘর, সাথে একটা বাথরুম, সামনে বারান্দা; আর পশ্চিমে পড়ে আছে। শূন্য ছাদ, যেখানে দুটি বড়ো ঘর উঠতে পারতো, কিন্তু ওঠে নি। এই শূন্যতাটাকে হাসানের ভালো লাগে; এবং ভালো লাগে সে অনেক উঁচুতে একলা আছে, তার ঘর আর ছাদ থেকে সে যেমন আকাশ দেখতে পায়- আকাশ সে বেশি দেখে না, তেমনি দেখতে পায় দূরে স্তূপ স্তূপ আবর্জনা, পৌর আবর্জনার তেতলা পাহাড়, একদিন এই আবর্জনা আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, সেদিন সে মন ভ’রে আকাশ দেখবে, দিকে দিকে বিবর্ণ তেতিলা চারতলা বিকলাঙ্গ বাড়ি, তার মনে হয় সে এক নিরন্তরতরঙ্গিত মলসমুদ্রের ওপর এক উচু নিঃসঙ্গ একান্ত বিজন মিনারে বাস করছে। এই পাঁচতলার ঘরটি তার টাওয়ার; কবিকে টাওয়ারেই থাকা দরকার, তাতে ডানা না থাকার অভাব পূরণ হয় অনেকখানি; কবির পায়ে মল মাটি কাদা লেগে থাকবে, কিন্তু তার চুল মেঘ আর নীলের ছোঁয়ায় মেঘ হবে নীল হবে। যদি সে একটা চুপচাপ এলাকায় এমন উচ্চ নিঃসঙ্গতায় থাকতো, যদি এই এলাকাটি হতো চার বর্গমাইলের একটি নিবিড় উদ্যান, তাহলে হয়তো কোনো এক অদ্ভুত আঁধারে সে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তো, কিন্তু এখানে তার লাফিয়ে পড়ার কথা মনে আসে না, সে জানে নিচে বয়ে চলছে প্রাণবন্ত জীবন, অশ্লীল অসুন্দর জীর্ণ পংকিল সুন্দর; ওই জীবন তাকে গলগল ক’রে বলছে, তুমি কখনো লাফিয়ে পড়বে না, মলস্তূপের মধ্যে ফুটে উঠবে তুমি, জীবন লাফিয়ে পড়ার জন্যে নয়, একদিন জীবন নিজেই প’চে গ’লে আবর্জনা হয়ে উঠবে।
দিঘির কালো জলে নয়, সে দেখতে পায় অনন্ত মলের স্থির প্লাবনের ওপর ফুটে আছে আদিগন্ত শুভ্ৰ পদ্ম; সে দেখে ডাস্টবিনে ঝলমল করছে সূর্যের থেকে বড়ো সূর্যমুখি। জীবন হচ্ছে বিপরীতের শিল্পকলা, কবিতাও তাই, সুন্দর অসুন্দরের অভাবিত অনিন্দ্য সঙ্গম।
হাসানের মনে হয়, বৃষ্টির হরিণের ধানখেতের মেঘের সৌন্দর্যের থেকে অনেক সুন্দর পথ জুড়ে যানজট, ট্রাকে ট্রাকে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাসস্টপে প’ড়ে থাকা কুণ্ঠরোগীটি চমৎকার কবিতার জন্যে, কবিতা ওকে রজনীগন্ধার পাপড়িতে পরিণত করবো, কবিতা রূপান্তরের আশ্চর্য রসায়ন।
গোলাপ রজনীগন্ধা আর এ-সময়ের ফুল নয়, আজকের ফুল আবর্জনায় গঠিত অভাবিত অপূর্ব, সুন্দর, যার কথা কেউ আগে ভাবতে পারে নি।
তার মনে হয়, কবিতা এখন সুশীল বিনীত পবিত্র পূজারী চায় না, চায় নষ্টভ্ৰষ্ট বদমাশ প্রচণ্ড দণ্ডিত প্রতিভা; সে নষ্টভ্ৰষ্ট হবে কিন্তু তার মতো সৎ। কেউ হবে না, সে বদমাশ হবে কিন্তু তার মতো মহৎ। কেউ হবে না, আর সে বইবে সকলের পাপ সকলের অপরাধ, সে হবে কবি।
হাসানের মনে হয় কবিতার জন্যে এই এলাকাটিই শ্রেষ্ঠ; এই মলস্তূপ থেকে একটি একটি ক’রে উঠে এসেছে তার অনেক কবিতা, আরো আসবে। কবিতা হচ্ছে পঙ্কজ মলজ: সেই কবিতা সে লিখবে।