হাসানের মনে হচ্ছে সে দুটি বিপরীত দেবী না উর্বশী না পরিহাসের সাধনা ক’রে চলছে; একটা অ্যাডের আরেকটি কবিতার; একটি তাকে বেতন দিচ্ছে ডেস্ক দিচ্ছে মাইক্রোবাসে নিচ্ছে আনছে টেলিফোন দিচ্ছে দামি সিগারেট খাওয়াচ্ছে হুইস্কি বিয়ারের সুযোগ দিচ্ছে তরুণীদের সঙ্গ দিচ্ছে, আরেকটি তাকে কিছুই দিচ্ছে না বা হতাশা দিচ্ছে ব্যর্থতা দিচ্ছে শূন্যতা দিচ্ছে, কিন্তু সেটির পুজোতেই (পুজো? সে কি পুজো ক’রে তার?) সে সুখ পায় বেশি, সেটিকেই সে পুজো করে অন্যটির সাথে বিছানায় যায়। অ্যাডের দেবী তাকে বদলে দিচ্ছে, মুখোমুখি ক’রে দিচ্ছে অজস্র অজানা বাস্তবেরও ও অবাস্তবের, তাকে খুলে দিচ্ছে, অনেক কুত্তার আর বাঘের আর বরাহের বাচ্চার সঙ্গে বসাচ্ছে, আর কবিতার দেবীও যেনো হারিতে চায় না, প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তাকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছে না–দু-চারদিন পরপরই দিচ্ছে একটি-দুটি পংক্তি, দু-একটি চিত্রকল্প, হঠাৎ ধ্বনিগুঞ্জন, দুটি-একটি যন্ত্রণা, এবং সে ওগুলোকে কবিতায় পরিণত করছে।
কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৬
দুটি সাময়িকীতে তার দু-গুচ্ছ কবিতা ছাপা হওয়ার পর সে নিজেই চঞ্চল বোধ করে, দুটি সম্পূর্ণ রাত কাটিয়ে দেয় বারবার নিজের কবিতা পড়ে, এবং নিজেকে প্রশ্ন ক’রে- কবিতাগুলো কি ঠিক এভাবেই লেখা অবধারিত ছিলো, সে কি এভাবেই লিখতে চেয়েছিলো, না কি এগুলো বাস্তবায়িত হ’তে পারতো অন্য রূপেও, এবং এগুলো আদৌ লেখার কোনো দরকার ছিলো কি না? স্ক্রিপ্টের জন্যে সে প্রশংসা পাচ্ছে, কিন্তু ওই প্রশংসাকে সে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে স্যান্ডল দিয়ে ডলছে; ব্যাকুল হয়ে থাকছে তার কবিতার জন্যে একটুকু প্রশংসার জন্যে, একটু প্ৰশংসা পেলে তা সে রক্তে গুচ্ছগুচ্ছ ফুলের মতো সাজিয়ে রাখছে। আধটুকু একটুকু প্রশংসার জন্যে সে এক সপ্তাহে দুটি আড্ডায় যায়, সিগারেট খাওয়ায় অন্যমনস্কভাবে, তবে অনেকে কেড়েই নেয় সিগারেট, তবু কারো মুখ থেকে প্রশংসা বেরোয় না; তবে সে বুঝতে পারে তার কবিতাগুলো পড়েছে। এরা, এই সম্ভাব্য মহাকবিরা, যারা নিজেদের ছাড়া অন্যদের কখনো প্রশংসা করে না।
হাসান, তুমি কেনো একটুকু প্রশংসার জন্যে কাতর? নিজেকে প্রশ্ন করে সে। ওই প্রশংসায় তো তুমি মহাকবি হয়ে উঠবে না, শহরে তোমার একটা চারতলা বাড়ি উঠবে। না, তবু তুমি কেনো সামান্য তুচ্ছ প্রশংসা চাও মনে মনে? কেনো এই এই লাল ক্ষুধা, কেনো এই সোনালি পিপাসা?
সামান্য একটু প্রশংসা হঠাৎ আলোর ঝিলিকের মতো, তাতে ভেতরের অন্ধকার কেটে যায়, শরীর জুড়ে অপার্থিব কােপন লাগে; চারতলা বাড়ি তোমাকে সে সুখ দিতে পারে না। সে নিজেকে বলে, মনে মনে বলে, কবি একটুকু প্রশংসার জন্যে নিরবধি কাল অপেক্ষা ক’রে থাকে, আমিও তো সেই কবি, অপেক্ষা ক’রে থাকবো, যদি একটু প্রশংসা পাই।
তাহলে তুমি যাও, হাঁটাে, বিব্রতভাবে গিয়ে আড়ায় বসো, প্রত্যাশা ক’রে থাকো অপেক্ষা ক’রে থাকো অসম্ভবের; তোমার ওই সঙ্গী কবিদেরই মনে করো মহাকাল, তারা প্ৰসন্ন হ’লে মহাকাল প্রসন্ন হবে। মহাকাল কী? মহাকাল তো এই তুচ্ছরাই; তারাই তো মহাকালের প্রতিনিধি।
কবিতাগুলো বেরোনোর দু-এক দিনের মধ্যেই আলাউদ্দিন রেহমান ফোন ক’রে তার কাতর রক্তে কাঁপন ধরিয়ে দেয়, অতিশয়োক্তিতে তাকে পুলকিত ক’রে তোলে; এবং দুপুরে বিয়ার খাওয়াতে নিয়ে যায়।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত তোমার স্ক্রিপ্ট ফাসক্যালাস হইছে, কিন্তু তোমার কবিতা অসাধারণ, প্রত্যেকটা লাইন আমারে কাঁপাই দিছে। স্ক্রিপ্ট তোমারে ভাত দিবো বিয়ার দিবো, আর কবিতা তোমারে বাঁচাই রাখবো।
হাসান বলে, তুমি আমার অনুরাগী বন্ধ ব’লে এতোটা প্রশংসা করছে। কিন্তু আড্ডায় গেলে শোনা যাবে ওইগুলো কবিতাই হয় নি।
হা হা হা ক’রে আলাউদ্দিন বলে, কবিরা কবে আবার অন্য কবির প্রশংসা করে? আমরা গার্মেন্টস্রা অন্য গার্মেন্টসের যেমুন প্রশংসা করি না, কবিতার ব্যবসায়েও একই ব্যাপার, অগো প্রশংসা তুমি পাইবা না। তাছাড়া অরা পড়েও না, অরা পড়ে না খালি ল্যাখে মাথায় যা পাগলামি আসে।
আলাউদ্দিন রেহমানের প্রশংসা তাকে সম্পূর্ণ ভরাতে পারে না, ভেতরে একটা বড়ো শূন্যতা থেকে যায়, তার কবিতার যদি প্রশংসা করতো রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী তাহলেও ওই শূন্যতা ভরতো না; তার সাধ হয় ওই যারা শস্তা রেস্তোরাঁয় স্টার টানছে ময়লা চা খাচ্ছে খিস্তি করছে বুকের ভেতর থেকে একটি-দুটি পংক্তি উচ্চারণ করছে, তাদের কথা শুনতে।
একদিন হেঁটে হেঁটে শেখ সাহেব বাজার রোডের এক রিকশা’আলা রেস্তোরাঁঁর আড্ডায় গিয়ে উপস্থিত হয় হাসান। রেস্তোরাঁঁর টেবিলে টেবিলে রিকশাআলারা পিরিচে ঢেলে চা খাচ্ছে দু-হাতে টেনে রুটি খাচ্ছে উচ্চস্বরে রেডিও বাজছে, তাদের লুঙ্গিগামছার গন্ধে চারদিক ভ’রে আছে; আর একপাশে সমকালীন কবিরা মহাকাল তৈরি করছে। হাসান দেখে অতিশয় উত্তেজিত অনুপ্রাণিত শিহরিত তুরীয় গলিত হয়ে আছে কবি সালেহ ফরিদউদ্দিন আর কবি আহমেদ মোস্তফা হায়দার। তাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোতে যাচ্ছে, নবাবপুরের আলেকজান্ড্রা প্রেসে লাইনোতে কম্পোজ শুরু হয়ে গেছে, তারা কবিতার প্রুফ দেখছে আর স্টার ফুঁকছে, চায়ের পেয়ালায় ছাই বাড়ছে, নীল বলপয়েন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে।