কিন্তু তুমি কবি? ভীষণ হাসি পাচ্ছে তার নিজেকে কবি ভেবে, খুব বিব্রত বোধ করছে, দাড়িঅলা জোব্বাপরা একটি বুড়ো হয়তো মিটিমিটি কিটিকিট হাসছে সব দেয়ালে; হাসান তাড়াতাড়ি ভাবনাটি খুব গভীর গর্তে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, যাতে কেউ দেখতে না পায়, শুনতে না পায়, গন্ধও না পায়।
নিজেকে কবি ভাবা খুব হাস্যকর, না? হাসান জিজ্ঞেস করে নিজেকে। হাস্যকর, খুবই হাস্যকর, এবং খুবই ভয়ঙ্কর। নিজেকে সে বোঝায়। অন্য সব কিছু স্বাভাবিক-ঠিকাদার হও, কালোবাজারি, আমলা, বেশ্যার দালাল, জোব্বা জজ মেজিস্ট্রেট ব্যারিস্টার হাবিলদার দফাদার চাটনাদার হও, ইস্কুল মাস্টার হও, দারোগী হও, ইন্ডেন্ট গার্মেন্টস ব্যাংক এনজিও দালাল হও; কিন্তু না, কবি না। সমাজ (চমৎকার নর্দমা, মলের স্তূপ, সতী বেশ্যা, অসতী সাধ্বী) কবি চায় না, কবির কোনো দরকার নেই সমাজে।
হাসান সমাজের চুনকামকরা মুখে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিতে চায়; তারপর থুতু আটকে রাখে, এমন নর্দমার ওপর সে খুতু ফেলতে পারবে না।
কবি? কী ক’রে কবি হ’তে পারি। আমি? কবি কাকে বলে? গালে পাঁচটি আঙুল বোলাতে বোলাতে হাসানের মনে হয়।
বেশ কয়েকবার ডান হাতের আঙুলগুলো নরমভাবে সে বোলায় তার গালে, একটু একটু রক্ত এখনাে বেরিয়ে আসছে বাল্যস্মৃতির মতো, বেরোেক। রক্ত, তুমিই হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, বেরোও; তুমি শরীরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছন্দ, নাচো; তুমি হাহাকার, ধ্বনিত হও।
কারো পক্ষেই কবি হওয়া সম্ভব নয়, মানুষের পক্ষে কবি হওয়া সম্ভব নয়। যার লিঙ্গ অণ্ড পাকস্থলি তলপেট আছে, তার পক্ষে কবি হওয়া অসম্ভব। রেজার চালাতে চালাতে আবার মনে হয় হাসানের।
কবি হতে পারি আমি, শুধু যদি আমি মানুষ না হই।
হাসানের আবার মনে হয়, মানুষের পক্ষে কবি হওয়া অসম্ভব।
কটি পদ্য লিখেছি? কটি কবিতা? একশো আশিটি হবে?
ঠিক মনে পড়ছে না তার, আবার মনের ভেতরে হো হে ক’রে হাসে হাসান। কোনো শব্দ হয় না, কিন্তু তার মনে হয় সে খুব উচ্চকণ্ঠে হাসছে, তার হাসি শুনতে পাচ্ছে সবাই।
কবি হ’তে হ’লে এই গরিব দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার কবিতা লিখতে হয় না? ঈদে আর কোরবানিতে কবিতা লিখতে হয় না?
ওর খালাশ হওয়ার দিনে তার ইন্তেকালের দিনে কবিতা লিখতে হয় না?
এই মাসের দশ তারিখে সেই মাসের চোদ্দো তারিখে কবিতা লিখতে হয় না?
হা হা ক’রে হাসে হাসান।
একাশিটা কাইব্য থাকতে হয় না?
হাসান নিজেকে বলে, তোমার তা কখনো হবে না।
এখন তোমার চারটি, সারাজীবনে হয়তো দশটি, যদি বেঁচে থাকো। তুমি কি বেঁচে থাকবে? বেঁচে থাকা কি খুবই দরকার?
প্যানের কাজ সেরে হাসান সিংকের সামনে দাডিয়ে ব্ৰাশে পেস্ট লাগায়, সবুজ রঙের পেস্টটাকে তার ঘেন্না লাগে, আসলেই ঘেন্না লাগে? না, হয়তো তার ভালোই লাগছে পেস্টটাকে; বেশ টিপতে হয় টিউবটাকে, নইলে বেরোয় না। তার মনে হয়। সে টিউবটাকে ভাঙছে, সে মনে মনে বলে, ভাঙতে হয় ভাঙতে হয়, কবিতার জন্যে শুধু অনবরত ভাঙতে হয়।
আমি কি নিজেকে যথেষ্ট ভেঙেছি, নইলে কবি হবো কীভাবে?
ব্ৰাশ করতে করতে নিজের নামটা মনে পড়ে হাসানের।
মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার। নিঃশব্দে হো হো ক’রে হাসে হাসান, বেশ নাম রেখেছিলেন শ্ৰদ্ধেয় আব্বাজান, দারোগার ছেলের জন্যে ফাসক্যালাস নাম। এই নামটাই আছে নোংরা সাটিফিকেটে, যদিও সাটিফিকেটগুলো কোথায় আছে তার মনে নেই; মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার, পিতা মোহাম্মদ রশিদ আলি তালুকদার। দারোগার পোলার নাম হিশেবে অনবদ্য। সে যদি দারোগা হতো, আর তার নাম যদি হতো মোহাম্মদ রশিদ আলি তালুকদার, তাহলে সে নিজের পুত্রের এই নামই রাখতো।
কিন্তু এই নামে কি কেউ কবি হ’তে পারে? কবি মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার? আবার হেসে ওঠে হাসান।
নিজের নামটিকেই সে প্রথম ভেঙেছে, প্রথম ভাঙতে হয়েছে; এবং দিন দিন নিজেকে ভাঙছে, আরো যে কতো ভাঙতে হবে–আর কিছু নয়, শুধু কবি হওয়ার জন্যে, দণ্ডিত মানুষ হওয়ার জন্যে ভেঙে ভেঙে চলা। নিজেকে ভাঙো, শব্দ ভাঙে, বাক্য ভাঙো, বাঙলা ভাষাকে ভাঙো, এবং নিরস্তর ভেঙে ভেঙে চলো। ভেঙে ভেঙে সৃষ্টি করো না, ভাঙলে কী সৃষ্টি করবে তুমি, হাসান রশিদ?
কিন্তু কবি আমি হ’তে পারবো না? হাসানের মনে হয়।
তখন সে এক গাছে ঢাকা পানিঘেরা গর্দভ মফস্বল শহর থেকে পাশ ক’রে ঢাকা এসেছে, খুব ভীরু পায়ে হাঁটছে সিংহ শহরে, শহর বুঝতে পারছে এক আগন্তুক এসেছে। দারোগা মোহাম্মদ রশিদ আলি তালুকদার চেয়েছিলেন তার স্টার পাওয়া মেধাবী ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, দশ হাতে টাকা বানাবে, দালানের পর দালান তুলবে, কিন্তু সে ঢাকা এসে কাপতে কাঁপতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলায় ভর্তি হয়ে যায়। প্রথম দু-তিন মাস বাড়ির কাউকেই জানায় নি কোথায় সে ভর্তি হয়েছে। সে জানতো বাঙলা কে পছন্দ করে? দারোগারাও বাঙলা পছন্দ করে না, বেশ্যারাও করে না, রাজনীতিবিদেরাও পছন্দ করে না, বাঙলা হচ্ছে শ্লোগান। বাঙলায় ভর্তি–এটা এক ভাঙা ভাঙি, তালুকদার সাহেব বছর তিনেক তার মুখও দেখেন নি, ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বাপ হ’তে না পারার দুঃখে পিতা দারোগা সাহেব মালপানি খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, পনেরো বছরের কাজের মেয়েটিকে, যে-মেয়েটির বুকে সে নিজেও একবার হাত দিয়েছিলো যে-মেয়েটির বুক খুবই নরম ছিলো যে-মেয়েটি তার কাছে একবার কবিতা শুনতে চেয়েছিলো, সেই মেয়েটিকে বিবাহেরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন।