না খেয়ে মরার কথায় নিজের দিকে তাকায় হাসান। সেও কি মরবে না খেয়ে? আলাউদ্দিন খুবই চমৎকার আছে, এমন চমৎকার থাকলে কবিতার কোনো দরকার পড়ে না হয়তো; বা কবিতা থেকে খুবই দূরে থাকলে মানুষ এমন চমৎকার থাকে। ঝকঝকে পংক্তি লিখতে থাকলে আলাউদ্দিনের সব কিছু আজ এমন ঝকঝকি করতো না, কোনো মরিয়ম দোলা ছড়াতো না; সে হয়তো কোনো দোস্তের অফিসে গিয়ে নিজের ভেতরের ময়লা খুঁটিতে খুঁটিতে পানটান করতো।
কবি, হায়, কুঁড়েঘরে বাস ক’রে শিল্পের বড়াই!
হাসান বলে, আমাকেও না খেয়ে থাকতে হবে, আলাউদ্দিন।
আলাউদ্দিন জিজ্ঞেস করে, তুমি কি করছে আইজাকাইল, দোস্ত?
হাসান বলে, কিছুই করি না, একটা কলেজে ছিলাম, ছেড়ে দিয়েছি।
আলাউদ্দিন বলে, আরো দোস্ত, তুমি দেখি লাইফেও পয়েট হইয়া ওঠতেছে, এইটা কবিতার জইন্যে ভাল না। এইটা অনাহারী কবিগো টাইম না, ছিঁড়া পাঞ্জাবি পরা কবিগো এইজ এইটা না; টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরির এই ডিকেডের কবি হইবো মডার্ন, তার লাইফস্টাইলও হইবো মডার্ন। তার গাড়ি থাকতে হইবো, তাকে ব্ল্যাক লেবেল খাইতে হইবো, রাইতে বাড়ি ফিরার সময় তাকে দেখতে হইবো শোনতে হইবো এভরি স্ট্রিটল্যাম্প দ্যাট আই পাস বিটুস লাইক এ ফ্যাটালিস্টিক ড্রাম। বোঝােলা ল্যাম্পপোস্টের বাইদ্য শোনাতে হইবো, ট্রাকরে ফুলের মালার মতন দেখতে হইবো, সন্ধাটারে ইথারে অজ্ঞান রোগীর মতন আকাশে ছারাইন্যা দেখতে হইবো। দাড়িমুখে সারিগান লাশরিকাল্লা, পাল তুলে দাও ঝাণ্ডা উড়াও, এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কাল কালর যুগ আর নাই দোস্ত।
হাসান বলে, গ্রামের কলেজে আমি ম’রে যাচ্ছিলাম, তিন বছর আমি কবিতা লিখি নি, একটি পংক্তিও মাথায় আসে নি। ঢাকা থেকে দূরে ছিলাম, তাই কবিতা থেকেও দূরে ছিলাম।
আলাউদ্দিন বলে, তুমি ত পল্লীকবি হইতে যাইতেছ না যে অই গাছপালা সোনাই রুপাইর মধ্যে কবিতা পাইবা। ঢাকার বাইরে আইজ কবিতা নাই।
হাসান বলে, তুমি তো জানোই আমার ওসব হবে না, আমি ওই মহান অক্সফোর্ডের উপযুক্ত নই।
আলাউদ্দিন বলে, তোমার লগে যেইটা সেকেন্ড হইলো সেইটা ত অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হইয়া ফাল ফারতেছে, মওলবি নজিবর রহমান আর কায়কোবাদরে লইয়া একাডেমিতে পরবন্ধ পরতেছে, বলতেছে তাগো মতন মহৎ ঐপন্যাসিক আর মহাকবি নাকি নাই। অইটারে তুমি অক্সফোর্ড বলতেছ? ফোর্ড আর নাই, খালি অক্সগুলি আণ্ডা দুলাইয়া শিং উচাইয়া গুতাগুতি করতেছে।
হাসান বলে, ইউনিভার্সিটি ওই নজিবর রহমান কায়কোবাদঅলাদের জন্যেই, আমার জন্যে নয়। কবি, ঔপন্যাসিকের জন্যে ওই দুর্গ নয়, ওটা সংঘবদ্ধদের জন্যে।
আলাউদ্দিন বলে, তোমার হইবো ক্যান? তুমি তা জমিরালি পরাগালির বাসায় বাজার কইর্যা দেও নাই, তাগো পোলামাইয়ারে চুয়িংগাম কিন্না খাওয়াও নাই, তাগো পায়ের ধুলা মাথায় মাখো নাই, তাগো লইয়া তিনখানা ভাঙচুরা পরবন্ধ লেখো নাই। তুমি কবি হইছো, তুমি বলি হইয়া গেছো।
হাসান বলে, কিন্তু আমি হয়তো কবি হবো না, কুকুরবাচ্চার মতোই নষ্ট হবো, আমি হয়তো কিছুই হবো না।
আলাউদ্দিন বলে, চলো দোস্ত, তোমারে একটু ভালমন্দ খাওয়াই আনি। লাঞ্চটা আমি অই চাইরতারাই করি। কবিতা ছাইর্যা ট্যাকা করতেছি ত চাইরতারা পাঁচতারায় যাওনের লিগাই, এইতে কবিতা ছারনের কষ্টটা একটু কমে–কি বুঝিতে চাই। আর জানি না কি আহা, সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের।
আলাউদ্দিন রেহমানের শীততাপমেঘবৃষ্টিকুয়াশাশিশিরকবিতাচিত্রকল্পনিয়ন্ত্রিত পাজেরোতে ওঠার সাথে সাথে একটা অদ্ভুত অপরিচিত অনামা আরাম ধাক্কা দেয় হাসানকে; যে-ট্রাকটি তার রিকশার পেছনে এসে গো গো ক’রে থেমেছিলো, তার মতো নয়, সেই দয়াময় ট্রাক একটি পংক্তি তাকে উপহার দিয়ে কবিতা লিখতে বলেছিলো, আর এই স্বপ্রকল্পনা আবেগসৌন্দর্যনিয়ন্ত্রিত পাজেরো তার ভেতর থেকে সব পংক্তি টেনে বের ক’রে নিয়ে নর্দমায় ফেলে দিতে চায়, বলে কবিতাঠবিতা ভুইল্যা যাও ভালো থাকবা। হাসান অনভ্যাসবশত একটু কান্ত হয়ে বসেছিলো, কান্ত হওয়ার সাথে সাথে অভাবিত আরামটা একগুচ্ছ ছুরির মতো গেথে যায়, তার মাংসে পাছার ভেতরে; সে পিঠটা টেনে নেয়। তার মনে হয়। পিঠ পেছনে ঠেকিয়ে বসলেই গুচ্ছ গুচ্ছ ছুরিকার আক্রমণে কবিতার কথা তার মনে থাকবে না, ছন্দ আর চিত্রকল্প সে ভুলে যাবে, সে অপরূপ অ্যাড গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং হয়ে উঠবে। সে শক্ত হয়ে ইস্কুলের বেঞ্চে ক্লাশ ফোরের ছাত্রের মতো বসে।
হাসান বাইরে তাকিয়ে একটি ভাঙাচোরা রিকশা দেখতে পায়, রিকশাটাকে তার বদলেয়ার র্যাঁবো মালার্মে রবীন্দ্রনাথের মতো মহানুভব মনে হয়, রিকশাকে সে গোপনে বলে, বিষন্ন রিকশা, করুণ রিকশা, অনির্বাচনীয় রিকশা, ডানাভাঙা রিকশা আমাকে একটি চিত্রকল্প দাও, অন্তত একটা ছেঁড়াফাড়া কবিতা দাও। আমার মানসসুন্দরী নেই, ধর্ষিত বিপন্ন ব্যথিত রিকশা, তুমি হও আমার ক্ষণিক মানসসুন্দরী।
পাজেরো শাই শাই ক’রে চলতে থাকে, আটকে যেতে থাকে, বলতে থাকে, অ্যাড গার্মেন্টস্ ইন্ডেন্টিং চারতারা পাঁচতারা ব্ল্যাক লেবেল অ্যাড গার্মেন্টস্ ইন্ডেন্টিং চারতারা পাঁচতারা ব্ল্যাক লেবেল মরিয়ম মরিয়ম মরিয়ম।
রিকশা বলে, আমি শিক আর টায়ার আর প্যাডেল, আমি বদলেয়ার র্যাঁবো মালার্মে রবীন্দ্রনাথ নই, এমনকি আমি যতীন্দ্রমোহন বাগচী মানকুমারী বসুও নই, মানসসুন্দরী নই, আমার ভেতরে কোনো কবিতা নেই, আমি তোমাকে কবিতা দিতে পারবো না।