কিন্তু না, আলাউদ্দিন আগের মতোই আছে; তার কণ্ঠস্বর তাই বলে। তার থেকে আলাউদ্দিন পাঁচ-ছ বছরের বড়ো হবে, কিন্তু সে যেভাবে ‘দোস্ত’ বলে তাতে মনে হয় তাদের একই বয়স।
টেলিফোনেই আলাউদ্দিন হৈ হৈ ক’রে ওঠে, আরো দোস্ত, এতকাল পর, কই থিকা কইতে আছো, তাড়াতাড়ি আইসা পড়ো।
হাসান আধঘণ্টার মধ্যেই গিয়ে উপস্থিত হয় আলাউদ্দিন রেহমানের অফিসে। আলাউদ্দিন তাকে জড়িয়ে ধ’রে পাগল হয়ে ওঠে। হাসানের মনে হয় তার অচেনা হয়ে যাওয়া স্যান্ডলের শব্দ যেনো চিনতে শুরু করছে শহর।
আলাউদ্দিন বলে, আমি আগেই বুঝছিলাম, কবিতাটবিতা আমার হইব না, অইসব চালাকি কবিতা না; সেইজন্য অ্যাড গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং হইয়া গেলাম। বাপেরও পয়সা আছিলো, আর দেখলাম কবিতায় না লাগলেও ব্যবসায় আমার চালাকি কামে লাগে: আর ট্যাকাপয়সাও একধরনের কবিতাই, মহাকাইব্যও কইতে পারে।
হাসান বলে, না, কবিতা-লেখা ছেড়ে তুমি ভালো করোনি।
চিতা আলাউদ্দিন বলে, কবিতা লেখন ছাইর্যা দিছি, কিন্তু পড়ন ছাড়ি নাই। তোমাগো কবিতা মন দিয়া পড়ি, সুধীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ বুদ্ধদেবের কবিতা আইজও আবৃত্তি করি, আমি বিংশশতাব্দীর সমান বয়সী, মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে, বীর নেই, যুদ্ধে যুদ্ধে। তোমার কয়টা কবিতা পড়লাম কাগজে, পইড়া মন ভইরা উঠলো। জানোই ত, তোমার লগেরগুলির মইধ্যে তোমারেই আমি খাঁটি কবি মনে করি, তোমারেই খাঁটি আধুনিক মনে করি।
হাসান বলে, আমিও অনেকদিন কবিতা লিখি নি, তবে এখন লিখছি, আরো লিখবো, কবিতা আবার ফিরে আসছে।
আলাউদ্দিন বলে, তোমার মইধ্যে খাঁটি কবি আছে, তোমারে কবিতা লেখতেই হইবো, তুমি কবিতা না লেখলে বড় লস হইবো। কবিয়ালে পাগলা কানাইয়ে দ্যাশ ভইর্যা যাইতেছে।
সে কবিতা না লিখলে ক্ষতি হবে? কার ক্ষতি হবে? কী ক্ষতি হতো জীবনানন্দ জন্ম না নিলে? তাহলে কি অ্যাড গার্মেন্টস্ ইন্ডেন্টিং বাঙলাদেশ দারোগা পুলিশ মন্ত্রী জজ সাবিজজ হতো না? কী লাভ হয়েছে জীবনানন্দ কবিতা লিখেছে বলে? কী ক্ষতি হয়েছে কেরামত আলি চাকলাদার কবিতা লেখে নি ব’লে?
হাসান বলে, তুমি কবিতা লিখছো না কেনো? তুমি ভালো লিখতে, তোমার ঝকঝকে পংক্তি আমার ভালো লাগতো। বাঙলায় কিছু ঝকঝকে কবিতাও দরকার, পানসে ম্যাদা পান্তা পদ্যে বাঙলা কবিতা, ভ’রে আছে।
হৈহৈ ক’রে চারপাশ কাঁপিয়ে তোলে আলাউদ্দিন; চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে এসে একবার হাসানকে জড়িয়ে ধরে। আলাউদ্দিন আরো মাংসল হয়েছে।
আলাউদ্দিন বলে, আরো দোস্ত, আমি যে কবিতা লেখা ছাইর্যা দিছি, এইতেই বোঝতে হইবো আমি কবিতাটিবিতা বুঝি, যার হইবো না তার ঠিক সময়ে ছাইর্যা দেওনাই প্রতিভার লক্ষণ। বাজে কবিতা লেখনের থিকা অ্যাড গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং করন অনেক ভাল, বাঙলার কবিগুলি এইকথা বোঝে না। সুধীন্দ্রনাথ ছাইর্যা দেয় নাই? সমর সেন ছাইর্যা দেয় নাই? তারা বোঝাছে আর কবিতা হইবো না, তাই ছাইর্যা দেওনই ভাল; কিন্তু এইকথা বিষ্ণু দে থিকা জসীমদিন বোঝে নাই। আর দ্যাখো না দ্যাশে যাইট সত্তরটা মূর্খ চিকনচাকিন লাইন লেইখ্যাই চলছে, বােঝতে পারছে না। অইগুলি ড্রেনের ময়লার থেইক্যা বেশি ময়লা।
হাসান বলে, তুমি তো ভালো ক’রে শুরুই করো নি।
আলাউদ্দিন বলে, এইখানেই তা আমার উইজডম ধরা পড়ে, শুরুতেই বুজছি হইবো না। তুমি আড্ডায় গিয়া দ্যাখো, পোলাপানগুলিন দাড়ি রাখতেছে, ময়লা কাপড় পরতেছে, গাজা টানতেছে, বেশ্যাবাড়ি যাইতেছে, বইপড়া ছাইর্যা দিছে, ভুল বাঙলায় লম্বাচিকন লাইন লেখতেছে, মাইয়ালোকের দুই চাইরটা উচানিচা জায়গার নাম লাইতেছে, ছাপাইতেছে, ভাবতেছে কবি হইতাছে। কিন্তু আইগুলির একশোটার মইধ্যে দুইটাও কবি হইবো না। এইকথা বোঝতে পারতেছে না।
হাসান বলে, একশোটির মধ্যে একটি বা দুটি কবি হবে, তার জন্যে ওই আটানব্বই নিরানব্বইটাও দরকার; অনেকে নষ্ট না হ’লে একটি দুটি কবি হ’তে পারে না। এটা মাছের ডিমের মতোই, পশুর বাচ্চার মতোই।
আলাউদ্দিন ঘণ্টা বাজাতেই একটি মেয়ে হাঁসের বাচ্চার মতো ঘরে ঢোকে। আলাউদ্দিন বলে, ম্যাডাম মরিয়ম, আইজ আমার আনন্দের দিন বাৰ্থ ডের মতন, অনেক বছর পর আমার পয়েট ফ্রন্ড আসছে, তারে একটু মালটাল ঢাইল্যা দিয়া খুশি করো। চাইয়া দেখো এই কবির দিকে, দ্যাশের বড়ো পয়েট হইবো বিশ বচ্ছর পর, তখন বলতে পারবা তার গেলাশে তুমি মাল ঢাইল্যা দিছিলা।
মরিয়ম বেশ ঝলমলে, তার সব কিছু দোলে; হাসানকে সালাম দেয়ার সময় তার বাহু আর বিভিন্ন অঙ্গ ঢেউয়ের মতো দুলে ওঠে, সব কিছু দুলিয়ে সে আলমারি থেকে ব্ল্যাক লেবেলের বোতল বের করে: ধবধবে শাদা গেলাশে সোনালি পানীয় ঢেলে তাদের সামনে রাখে। কেরুর থেকে এটা কতোই ভিন্ন কতোই উজ্জ্বল। হাসানের চোখে একবার দুলে ওঠে কংকাবতী আফ্রোদিতি।
আলাউদ্দিন মরিয়মকে বলে, ম্যাডাম অইদিকে জানাই দেও আমি বিজি আছি, এখন কোনো লোক না কোনো ফোন না।
মরিয়ম ফোনে সংবাদটি ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে থাকে। আলাউদ্দিন বলে, ম্যাডাম, চাইলে তুমিও একটু খাও।
তারা দুজন পান শুরু করে, হাসান পানীয়র সাথে একটি ব্যাপক দোলনও পান করতে থাকে।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, তুমি বলছিলা মাছের আন্ডার মতন কুত্তার বাচ্চার মতন অনেকগুলি নষ্ট হইয়া একটা দুইটা কবি হইয়া বাইর হয়, ঠিক কথাই কইছো, কিন্তু আমি অই পাঁচটা কুত্তার বাচ্চার চাইরটার মইধ্যে পড়তে চাই নাই। তাতে কি হইতো? কবিও হাইতাম না, এইদিকে না খাইয়া মারতাম, ব্ল্যাক লেবেলের বতলের কাছেও যাইতে পারতাম না।