দুটি নদীর মিলনস্থলের মতো সে আবার প্রবেশ করে, তার মনে হ’তে থাকে সে কখনো মানুষ ছিলো না, ছিলো হয়তো কোনো বন্যপ্ৰাণী, সবুজ জঙ্গলের পাতার আদরে সে হাজার হাজার বছর ধ’রে বেড়েছে, গুহায় বাস করেছে, কাদায় গড়িয়েছে অনন্ত কাল; হয়তো সে ছিলো নদী, বা পুকুর, বা ধানখেত, বন্যশুয়োর বা মত্ত হাতি বা ক্ষুধার্ত বাঘ।
ভোর হয়ে এলে কংকাবতী বলে, যাইতে ইচ্ছা করতেছে না, এই দিকে ভোর হইয়া আসতেছে।
আফ্রোদিতি বলে, এমুন রাইত আর আসব না, যত দিন বাচুম এই রাইতরে মনে করুম।
হাসান বলে, আমার জীবনেও আসবে না; তোমরা আবার এলেও এ-রাত আর আসবে না। তোমাদেরও আমি আর কোনো রাতে চাই না।
মেয়ে দুটি একটু আহত বোধ করে।
আফ্রোদিতি বলে, আমাগো আপনে ঘিন্না করতেছেন, সাব?
হাসান বলে, না, না, ঘেন্না নয়। তোমাদের নিয়ে আজ রাতে আমি একটি শরীরের কবিতা লিখেছি, পবিত্র অপরাধ করেছি, যা আমি আর কোনোদিন লিখতে পারবো না কোনোদিন করতে পারবো না।
কংকাবতী আফ্রোদিতি বেরিয়ে যায়, হাসান বিছানায় গড়াতে থাকে।
কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৫
রাতভর কি তুমি অন্ধকার অপবিত্র অপরাধ করেছে, হাসান? নিজেকে সে জিজ্ঞেস করে। তোমার কি মনে হচ্ছে অপরাধ করেছাে তুমি? অপবিত্ৰ দূষিত পাপী তুমি? না, আমার তা মনে হয় না; হাসান, তুমি যা করেছে, তা পবিত্ৰ শুদ্ধ, সন্তরা ওই শুদ্ধতার ছোঁয়া পাবে না কখনো। তুমি কি ক্লান্তি বোধ করছো? না। ক্লান্তি আর কিছু নয়, অন্ধকার অপরাধবোধ; যদি তুমি ক্লান্তি বোধ করতে, এই আশ্চর্য নদী নৌকো পাল নোঙর শ্রাবণের রাতটি যদি ভোরবেলা চেপে ধরতো তোমাকে, তাহলে বুঝতে হবে তুমি সারারাত পবিত্ৰ শুদ্ধতায় ছিলে না, ছিলে অপবিত্র অপরাধবোধের মধ্যে; মাংস তাহলে হতো তোমার কাছে পুরোনো গ্রন্থের পাপ, রক্ত হতো তোমার কাছে আদিম অপরাধ; মানুষের মাংস রক্ত কখনো অশুদ্ধ হয় না অপবিত্র হয় না। মাংস রক্ত নিয়ত পবিত্র নিয়ত বিশুদ্ধ।
কয়েক দিন সে আর আড্ডায় যায় না, মনে হয় বাচালতায় আবর্জনায় গিয়ে সে। ডুবে যাবে, মাথা আর বুকে পঙ্ক জমবে; সে ঘর থেকে বেরোয় শুধুই বিকেলে, একা একা পথে পথে হাঁটে, মানুষের মুখের দিকে তাকায়, পথে-পথে একটি-দুটি কবিতার পংক্তি পায়, ঘরে ফিরে আসে, এবং পংক্তিগুলোকে কবিতায় পরিণত ক’রে ক’রে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়।
কবিতাগুলো তার কাছে বিস্ময়কর আসতে থাকে।
একটি পংক্তি হয়তো সে পেয়েছে গুলিস্থানের মোড়ে দাঁড়িয়ে, পংক্তিটি মাথায় নিয়ে হাঁটছে, আর কোনো পংক্তি আসছে না, আটকে গেছে মাথায়।
ঘরে ফিরে এসে পংক্তিটিকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েও সে কবিতায় পরিণত করতে পারছে না; কিন্তু তখন অন্য একটি পংক্তি আসছে, অবলীলায় কবিতা হয়ে উঠছে, খাতার পাতাটির দিকে তাকিয়ে থাকছে সে অনেকক্ষণ’।
কবিতা কি এলোমেলো পাগল পংক্তির সমষ্টি, নিরর্থ প্ৰলাপ? হঠাৎ গুনগুনিয়ে উঠলো। যে-পংক্তিটি, যেটি মুগ্ধ করলে আমাকে, সেটির সাথে আরো কয়েকটি ময়লা। পংক্তি জুড়ে দেবো আমি?
না। কবিতা এলোমেলো পাগল পংক্তির সমষ্টি নয়। কবি পাগল হ’তে পারে, বদ্ধ পাগল, কিনতি কবিতা পাগল হবে না, কবিতা ধাঁধা নয়।
কবিতা হবে সম্পূর্ণ কবিতা, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কবিতা, আমি সম্পূর্ণ কবিতা চাই, সম্পূর্ণ কবিতা লিখতে চাই।
কবিতা হবে অভাবিত প্রগাঢ় চিত্রকল্পমালা, চিত্রকল্পের অগ্লোৎসব।
একটি একটি ক’রে অবলীলায় ও সংশোধন ও সংশোধন ক’রে এবং অবলীলায় কয়েক দিনের মধ্যে সে একগুচ্ছ সম্পূর্ণ কবিতা লিখে ফেলে।
তোমাদের কোনাে মূল্য নেই, তোমরা সাবান টুথপেস্ট নও চটি জুতো আন্ডারওয়ার নও কয়লার টুকরো পাউরুটি নও ধানের গুচ্ছ নও, তোমাদের কোনাে দাম নেই, তবে আমার কাছে তোমরা মূল্যবান। হাসান মনে মনে বলে।
কয়েক দিনে ধরেই হাসানের মনে পড়ছে আলাউদ্দিন রেহমানকে, যে তাকে প্রথম অনুপ্রাণিত করেছিলো নিজেকে ভাঙতে, সে মােহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার থেকে হয়ে উঠেছিল হাসান রসিদ। আলাউদ্দিন রেহমান, যে ঝকঝকে কথা বলতো সিগারেট টানতে টানতে চায়ের কাপ ঠোঁটে লাগাতে লাগাতে, দু-একটি ঝকঝকে কবিতাও– কবিতার পংক্তিও লিখেছিলো, অধ্যাপক আহমদ আলির সাথে গোলমালের ফলে যে তৃতীয় শ্রেণী পেয়েছিলো, তাকে আর কবিতার আড্ডায় পাওয়া যায় না, মাঝেমাঝে শুধু তার নাম ওঠে ঝ’রে পড়া পাতার মতো; সে এখন অ্যাড গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং, সে আর কবিতা লেখে না। তার ঝকঝকে কালো রঙ আর থলথলে স্বাস্থ্য ঝিলিক দেয় হাসানের চোখে। তার টেলিফোন নম্বরটিও জোগাড় করেছে হাসান, কিন্তু টেলিফোন করা হয় নি; টেলিফোন করার কথা মনে হ’লেই কষ্ট লাগে, আলাউদ্দিন শক্তি আর কবিতা লেখে না, কবিতার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই, তাকে আর টেলিফোন করা হয় না।
একদিন হাসান তাকে টেলিফোন করে।
আলাউদ্দিনকে পেতে বেশ কষ্ট হয়–প্রথম একটি মেয়ে টেলিফোন ধরে, তাকে নিজের নাম বলতে হয়;–টেলিফোনে কেউ তার নাম জিজ্ঞেস করলেই সে অস্বস্তি বােধ করে, নিজের নামটা বলার সময় তার মনে হয় সে যেনাে সকলের পায়ের নিচে প’ড়ে গেছে, হঠাৎ তুচ্ছতম হয়ে গেছে, তার কোনাে নামপরিচয় নেই, অনেকক্ষণ ঠিক করতে পারে না সে কী বলবে–সে কি বলবে ‘আমি হাসান রশিদ’, নাকি বলবে ‘আমার নাম হাসান রশিদ’, ঠিক করতে পারে না সে; এক সময় সে বলে, ;আমার নাম হাসান রশিদ’, তারপর তাকে পাঁচ মিনিট ধরে শুনতে হয় গানবাদ্য, তারপর জানতে হয় স্যার আরেকটি টেলিফোনে কথা বলছেন, এবং শেষে সে আলাউদ্দিনকে পায়। এভাবে পেয়ে হাসান বুঝতে পারে আলাউদ্দিন রেহমান কেনো কবিতার থেকে দূরে আছে।