মেয়ে দুটি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মাথা নিচু করে বিছানায় বসে থাকে। হাসান বলে, নগ্নতা মাথা নিচু ক’রে থাকার জন্যে নয়, কংকাবতী; নগ্নতা লজ্জা পাওয়ার জন্যে নয়, আফ্রোদিতি।
হাসান একটি বস্তু দেখিয়ে বলে, এ হচ্ছে পবিত্র ভ্রাতা।
কংকাবতী আফ্রোদিতি সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
হাসান একটি বস্তু দেখিয়ে বলে, এ হচ্ছে বিশুদ্ধ ভগিনী।
কংকাবতী আফ্রোদিতি কেঁপে ওঠে।
হাসান তাদের প্রসারিত অঞ্চলে হাত বুলিয়ে বলে, এ হলো সবুজ তৃণভূমি; এখানে তৃণ ঘাস থাকার কথা ছিলো, কেনো নেই?
মেয়ে দুটি হাসে, তাদের হাসিতে ঘাস গজিয়ে ওঠে।
হাসান মন্দিরের দরোজায় হাত রেখে বলে, এটা হচ্ছে দেবীমন্দির, এই মন্দিরে সবাই পুজো দেয়, সবাই মাথা নত করে। আমি পূজারী।
মেয়ে দুটি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে
হাসান বিছানায় উঠে তাদের মাঝখানে ব’সে বই খুলে জীবনানন্দের ‘অন্ধকার’ কবিতাটি পড়তে থাকে, তার স্বরে মেয়ে দুটি মুখ তুলে হাসানের দিকে তাকায়।
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনিত ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি। কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি। হে নর, হে নারী, তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন; আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।
কংকাবতী গেলাশে চুমুক দিতে দিতে জড়ানো স্বরে বলে, আপনে কি পরতেছেন বোঝতে পারতেছি না, তয় মনে হইতেছে আমি পুকইরের কালা পানির ভিতর সাতর কাটতাছি, ডুবাইতে ডুবাইতে পুকইরের মইদ্যে গিয়া শাপলাফুল তোলতাছি, আমার উপর মেঘ পরতেছে, আমার চুল ভাইস্যা যাইতাছে। সাবা আপনে পরেন, রাইত ভইর্যা পরেন।
কংকাবতী একটি হাত দিয়ে জড়ায় হাসানকে, ওর শরীর থেকে ধূমায়িত একটি গন্ধ না সুগন্ধ না রঙ এসে ঢাকতে থাকে হাসানকে।
গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; আমাকে কেন জাগাতে চাও? হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগাতে চাও কেন।
আফ্রোদিতি কাঁপা কাঁপা হাতে হাসানের ঠোঁট ছোঁয়, হাসানের স্বর্গীয় অরণ্যের তলদেশে সোনালি সাপের ফণায় গিয়ে যেনো ওর আঙুল লতাগুল্মজালে জড়িয়ে পড়ে, সে জড়ানো গলিত স্বরে বলে, আমার মনে হইতেছে গোস্তের ভিতর আগুন জ্বলতেছে, আমার দেহে আর গোস্ত নাই, সব পুইর্যা আগুন হইয়া জ্বলতেছে, সাবরে জরাইয়া ধইর্যা আমার পদ্মানদীর ঢেউয়ের লগে ভাইস্যা যাইতে ইচ্ছা হইতাছে, সাব, আপনে আমারে ধরেন, আমার সবখানে আপনের হাত দেন, গলায় কামড় দেন, শিনায় কামড় দেন, সবখানে আপনের দাঁত বসাইয়া দেন।
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর; তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকিব–ধীরে–পাউষের রাতে–কোনোদিন জাগাব না জেনে–কোনোদিন জাগাব না আমি–কোনোদিন আর।
কংকাবতী বলে, আরও পরেন, সাব, মেঘ হইতাছে বাজ ডাকতাছে, ঘরের চাল উইর্যা যাইতাছে।
হাসান বলে, কংকাবতী আফ্রোদিতি, তোমাদের পূর্ণিমাজ্বলা স্তনের দিকে তাকিয়ে দেখো, তোমাদের স্তন পদ্মার নৌকোর পালের মতো ফুঠে উঠছে, পালে আষাঢ় শ্রাবণের ঝড় ঢুকছে বৃষ্টি ঢুকছে।
হাসান বিপর্যস্ত মাঝির মতো পালগুলো স্পর্শ করে, দড়ি টেনে টেনে যেনো মাস্তুলের শীর্ষে তুলতে থাকে; একটি পাল থেকে আরেকটি পালে যেতে থাকে, তার আঙুল আর ওষ্ঠ শ্ৰাবণ হয়ে বয়ে যেতে থাকে–পাল থেকে নৌকোয়, ছাইয়ে, গলুইয়ে, সমস্ত বাকে, এবং সে দেখে তার নোঙর কোনো গভীর অতলে ডুবে যাওয়ার জন্যে অনন্ত কাল ধ’রে যেনো অপেক্ষা ক’রে আছে।
কংকাবতী জিজ্ঞেস করে, পাল কারে কয়?
হাসান বলে, নৌকোর বাদাম, এই যে দুটি বাদাম।
আফ্রোদিতি বলে, এমুনি কইর্যা বাদাম আগে কোনোদিন ফোলে নাই।
কংকাবতী বলে, আমার বাদাম থারথার কইর্যা কাপতেছে, গাঙে তুফান আসছে, এমুন তুফান আর আসে নাই।
হাসান বলে, তোমাদের শরীর সোনার গাছের মতো ঝলমল করছে। তোমরা সোনার গাছ, তোমাদের ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে আঙুরের লাল কামনা। মানুষ হচ্ছে সোনার গাছ, তার শিরায় শিরায় রক্ত নয় বয়ে চলে আঙুর।
আফ্রোদিতি বলে, প্রত্যেক রাইতে আপনেরে লইয়া আমার থাকনের ইচ্ছা হইতেছে, তয় আপনেরে তা পামু না। আপনে বলছিলেন আপনে পাগল, নিজেরে আমার মনে হইতেছে পাগলি। আমি পাগলি, আমারে ধইরা যা ইচ্ছা করেন, ছিইর্যা ফালান, ভাইঙ্গা ফালান, আমি জ্বইল্যা যাইতেছি।
কংকাবতী বলে, রাইত য্যান না ফুরায়, আমার যান ঘোম না আসে।
হাসান ঘুমের ঘোরে নোঙর ফেলতে থাকে, সে এক সোনার নৌকো থেকে আরেক সোনার নৌকোয় গড়িয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে, নৌকোর ছইয়ে উঠতে থাকে, গলুইয়ে গিয়ে বৈঠা বাইতে থাকে, এক নদী থেকে যেতে থাকে আরেক নদীতে হাজার বছর ধ’রে অনন্ত বৃষ্টিতে অনন্ত অন্ধকারে অনন্ত চাঁদের তলে, সে গ’লে যেতে থাকে জলের মতো, আবার নোঙর হয়ে উঠতে থাকে, নোঙর ফেলতে থাকে, তীর ভেঙে পড়তে থাকে নদী তোলপাড় ক’রে।
আলোটাকে এক সময় হাসানের কাছে মনে হয় অশ্লীল অসভ্য অন্ধকার, কেঁপে কেঁপে উঠে সে আলোটা নিভিয়ে দেয়, অন্য আলো ছড়িয়ে পড়ে।