- বইয়ের নামঃ কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০১
আমি সম্ভবত দণ্ডিত মানুষ, আমি কবি।
ভোরের কাজগুলোকে অসহ্য একঘেয়ে বিরক্তিকর লাগে হাসানের; কেনো যে ভোর হয়, গোলগাল লাল সূর্য ওঠে পুব দিকে, এর থেকে চমৎকার হতো এক অন্ধকারে এক দীর্ঘ আলোতে সব কিছু কেটে গেলে;–দিনের পর দিন ঘুম থেকে ওঠে, শক্ত বস্তুটাকে চেপে একটু দ্রুত বাথরুমে যাও, ঝরঝর ঝরঝর করো, ফিরে আসো, তলপেটটাকে মুক্ত করার জন্যে লাল ঝলমলে চা খাও এক কাপ, দু-কাপ হ’লেই জমজমাট হয়, সঙ্গে পর পর দু-তিনটি সিগারেট-এ-দুটো কাজই শুধু বিরক্তি থেকে মুক্তি দেয় তাকে, তারপর গিয়ে প্যানের ওপর নতুন খালের কিনারের সেই মাথায় লাল গামছা চাষীটার মতো বসো, গলগল করো চেপে চেপে মুক্ত হও, বুনো ঘাস আগাছার মতো গজিয়ে ওঠা দাড়ি কাটাে, ফ্লাশ টানো, পানি না বেরোলে আবার টানো, বদনা লাগাও, ব্ৰাশ করো, ওপর থেকে নিচে নিচ থেকে ওপরে, জিভ শানাও খশখশ ক’রে, ভেতর থেকে ইতরের পালের মতো ছুটে আসা বমিটাকে রোধ করো, জিভটার বর্ণ গন্ধ স্বাদ বদলে যাচ্ছে দিন দিন, এক বালতি পানিতে গোশলটা তাড়াতাড়ি সেরে নাও, অত্যন্ত জঘন্য এই সাত শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুকুরে ভরা জীবন নামের ঢলঢলে কাজের মেয়েটি, বিশেষ ক’রে তার ভোরবেলাটি। সবচেয়ে বিশ্ৰী লাগে দাড়ি কামাতে, গালটা টনটন করে, কোনো কোনো দিন ব্লেডটাকে মনে হয় জংধরা ছুরি, অশীল অশ্লীল আগাছার মতো লোমগুলো রেখে দিতেই ইচ্ছে হয়, কিন্তু লোমগুলোকে ঘেন্না লাগে ব’লে কামানো ছাড়া উপায় নেই। প্যানের ওপর বসলে ঝলমল ক’রে মনে পড়ে ইস্কুলে যাওয়ার পথের ধারের নতুন খালটিকে, সেই চাষীটাকে মনে পড়ে, লুঙ্গি উঠিয়ে যে ‘ঙ্গ’র মতো অদ্ভুতভাবে ব’সে ছিলো চোখ বন্ধ করে, খুব কষ্ট খুব সুখ হচ্ছিলো মনে হয় লোকটির, নিজেকে ওই চাষী মনে হয়, হাসি পায় হাসানের, ভালো লাগে। বেশ হতো চাষী হ’লে; আহা, খালের পাড়ে ব’সে প্রসন্ন পর্যাপ্ত প্রকৃতি। প্যানের ওপর বসে সে দাড়ি কামানোর কাজটিও করে, এক সঙ্গে দু-কাজ- এ-অভ্যাসের জন্যে সে ধন্যবাদ দেয় নিজেকে, এটা সে কখন যে শুরু করেছিলো আজ আর মনে নেই, এটাকে তার একটা উৎকৃষ্ট পদ্যের পংক্তি মনে হয়; খুব ভালো লাগে তার যে আয়নাটায়না তার লাগে না, চোখ বুজেই সে নিজের মুখটি দেখতে পায়, চোখের ভেতরেই তার একটি আয়না আছে, আর আঙুলগুলোই কাজ করে চোখের, দশটি চোখ দু-হাতে, তার কোনো ক্রিমট্রিম মাখতে হয় না, ধবধবে ফেনা তুলতে হয় না, যদিও শোভিং ক্রিমের দুটি বিজ্ঞাপন সে নিজ হাতে লিখেছে, পানি লাগিয়েই সে রেজর চালাতে পারে–মসৃণ বিরক্তিকর।
আজ প্যানের ওপর বসে গালটাকে ভিজিয়ে রেজার টান দিতেই ব্লেডের একটা দুরন্ত কোনা গালের ডান পাশে গেথে যায়, একটু কোপে ওঠে হাসান, এবং গালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া সরু লাল রক্তধারার মতোই গড়িয়ে গড়িয়ে তার মনে আসে ভাবনাটি- আমি সম্ভবত দণ্ডিত মানুষ, আমি কবি।
গাল টিপতে টিপতে একবার সে মনে মনে হেসে ওঠে হো হো করে; কোনো শব্দ হয় না, তবে তার মনে হয়। সে হো হো ক’রে হাসছে; এবং তার সাথে হাসছে শহরের সবাই। খালের পাড়ের সেই মাথায় লাল গামছা চাষীটাও।
বেশ লাগছে হাসানের, আজ ভোরবেলা গালে লাল সরু রক্তধারার মতো চুইয়ে চুইয়ে একটির পর একটি ভাবনা আসছে, ভাবনাগুলো তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। ভাবনার সঙ্গী ও রক্ত মাংসময়।
আমি মানুষ? তাহলে আমি এমন কেনো? আমি কেমন?
ওই ঠেলাগাড়িঅলার মতো নাই কেনো? আমি কি নই? করিমউদ্দিন ব্যাপারীর মতো নাই কেনো? আমি কি নই? নাই কেনো ভেড়ামারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাগল ছাগল ভিসিটার মতো? আমি কি নাই? গাভী গাভী পাটখেতের চাকর চাকর গাধা গাধা। মাননীয়টার মতো নাই কেনো? আমি কি নই? নিচের তলার ওই ভদ্র আর অভদ্রলোকটির মতো নাই কেনো, যে আরো নিচের তলার কাজের মেয়েটিকে সিঁড়িতে দেখলেই একটা সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়ায়, হাসে, পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের ক’রে মেয়েটার ব্লাউজের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতটা কিছুক্ষণ চেপে রাখে, যার লিকলিকে বউটি বিয়োয় বছর বছর?
আবার হেসে ওঠে হাসান নিঃশব্দে হো হো ক’রে।
তাহলে আমি মানুষ নই? আমার কি মনে হয় আমি মানুষ নই? স্বাভাবিক মানুষ নাই আমি? নিজেকে জিজ্ঞেস করে হাসান।
তুমি কি মানুষ নও? তুমি কি স্বাভাবিক মানুষ নও? তুমি কি সকালে উঠে ঝরঝর করার জন্যে বাথরুমে ঢোকো না? প্যানের ওপর বসো না সেই চাষীটার মতো, শুধু তোমার অভাব তোমার কোনো নতুন কাটা খাল নেই? পেয়ালা ভ’রে চা খাও না? দু-তিনটি সিগারেট খাও না? একটু কাশো না? ব্রাশ করো না? শোভ করো না? চুল আঁচড়াও না? ভাত খাও না? কাম বোধ করো না? ওই কাজের মেয়েটার দিকে তাকাও না? ধনে পাতার গন্ধে তুমি এলোমেলো হও না? বিলে গিয়ে আজো কি জ্যৈষ্ঠের বৃষ্টিতে তোমার বােয়াল মাছ ধরতে ইচ্ছে করে না? লিফটে আটকে যাওয়ার ভয়ে তোমার কি দম বন্ধ হয়ে আসে না? ইচ্ছে করে না লাফিয়ে। পড়তে? মুহূর্তের জন্যে কি পৃথিবীটাকে তোমার একটা বদ্ধ ঘর মনে হয় না, এবং আধামিনিট ধ’রে তুমি কি ভোগো না ক্লস্ট্রফোবিয়ায়? বেবিঅলার কথায় মাঝেমাঝে রেগে ওঠে না তুমি? তুমি তো সবই করো।