আগে অবশ্য ব্যাপারটা এরকম ছিল না। ভাল না হোক, বউদি অন্তত খুব খারাপ ব্যবহার বা অপমান করত না। কাউকে। কিন্তু গোলমালটা পাকাল পাড়ার পল্টু।
মাস ছয়েক আগে তার দাদা আর বউদি মিলে তুমুল চেঁচামেচি আর অশান্তির পর চয়নকে আর মাকে বাড়ি থেকে। তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাড়িটা দাদার এবং দাদার পয়সাতেই মোটামুটি সংসার চলে। কিছু করার ছিল না তাদের। এক দিদি থাকে উল্টোডাঙা হাউসিং-এ, সেখানেই যেতে হত তাদের। গিয়ে কী হত কে জানে? তবে পোটলা-পুঁটলি বাক্স নিয়ে একরকম পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু সদর খুলে বেরোতেই এক বিপরীত দৃশ্য। সামনে পল্টু দাঁড়ানো, পিছনে পাড়ার বিস্তর ছেলে এবং কয়েকজন মহিলাও।
পই এগিয়ে এসে মাকে বলল, মাসীমা, ঘরে যান। চয়নদা, তুমিও ভিতরে যাও। আমরা না বললে খবৰ্দার বাড়ি ছাড়বে না।
পল্ট পাড়ার মোড়ল গোছের। তার ক্লাব আছে। মাঝে মাঝে রক্তদান শিবির, নাটক ইত্যাদি করে। তার প্রবল দাপটে পাড়ায় সাট্টার ঠেক আর দিশি মদের আস্তানা উঠে গেছে। পলিটিকসও করে।
ভয়ে চয়ন তার মাকে নিয়ে দরজাতেই দাঁড়িয়ে রইল। ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা।
তাদের পাশ কাটিয়ে পল্টু ঘরে ঢুকে সোজা দাদার গলায় হাত দিয়ে চেপে ধরল দেয়ালে, এ পাড়ায় বাস করতে চান? যদি চান তাহলে এবার থেকে মা আর বেকার ভাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। করলে আপনাকেও এ বাড়ি ছাড়তে হবে। কথাটা আপনার বউকেও বুঝিয়ে দেবেন।
কথাটা বেশ নাটুকে এবং বীরত্বব্যঞ্জক বটে, কিন্তু ঝামেলা অত সহজে মেটেনি। বউদি ঝাঁপিয়ে পড়ল পল্টুর ওপর। তারপর অকথ্য গালিগালাজ। পাড়ার লোক ভিড় করে এল। পল্টুর বীরত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠল। পারিবারিক ব্যাপারে বাইরের লোকের নাক গলানো কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও কথা হতে লাগল। তবে মোটামুটি জনসাধারণের চাপে তারা রয়ে গেল দাদার বাড়িতে। সম্পর্কটা খুবই খারাপ হয়ে গেল এর পর। দাদা পল্টুর এই হামলা নিয়ে প্রবল আন্দোলন করতে লাগল। এমন কি গুণ্ডা লাগানোর চেষ্টাও করেছিল।
দাদার হাতে ছেলেবেলায় বিস্তর মারধর পেয়েছে চয়ন। বড় হওয়ার পর খায়নি। কিন্তু পর হামলাবাজির পর সেই রাতেই দাদা তাকে একটা লাঠি দিয়ে খুব পেটায়। সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল মার খেয়ে। পরে শুনেছে, বউদি একটা কৌটো ছুঁড়ে মেরেছিল মাকে।
এর পরও তারা আছে। বাড়িটা ছোটো এবং পুরোনো। এ বাড়িতে তারা ভাড়া থাকত একসময়ে। পরে বাড়িওলার। কাছ থেকে দাদা সস্তায় কিনে নেয়। বাড়ি কেনার পর থেকেই দাদার ভয়, বেশী দিন এ বাড়িতে থাকতে দিলে চয়নের দাবী জন্মে যাবে।
এই ঘটনার পর থেকেই চয়নকে কেউ খুঁজতে এলে বউদি ভীষণ চেঁচামেচি করে। চয়নের নামও সহ্য করতে পারে না দুজন।
আশিস যেন অসময়ে গিয়ে হাজির না হয়, হে ভগবান! এইটুকু বলে এসপ্লানেডে একটা সীট পেয়ে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল চয়ন। গভীর ক্লান্তির ঘুম।
গোল পার্ক টার্মিনাসে কন্ডাক্টর ডেকে তুলে দিল তাকে। মোহিনী তাকে দেখে আঁতকে উঠে বলে, কী হয়েছে চয়নদা! পড়ে গিয়েছিলেন নাকি? জামাকাপড় তো কাদায় মাখামাখি।
চয়ন যথাসাধ্য গম্ভীর হয়ে বলে, রাস্তা যা পিছল।
ইস, ভেজা জামাকাপড়ে থাকবেন?
কিছু হবে না। রোজ তো বৃষ্টিতে ভিজছি, এত জামাকাপড় পাবো কোথায়?
বাবার ধুতিটুতি কিছু দেবো?
চয়ন শিহরিত হয়ে বলে, না না। কিছু লাগবে না।
এ বাড়িতে বিকেলে দুখানা মাখন টোস্ট পাওয়া যায়। এক কাপ চা। কখনও কখনও অবশ্য টোস্টের বদলে বিস্কুট। আজ টোস্ট দুখানা তার বড় দরকার। খিদে পেয়েছে।
সে এক গ্রাস জল চেয়ে খেল এবং পড়াতে লাগল।
চয়নদা, আপনাকে কিন্তু অসুস্থ দেখাচ্ছে। ফ্যাকাসে লাগছে খুব। পড়ার মাঝখানে বলে ফেলে মোহিনী।
মৃগী রোগের কথা শুনলে এরা হয়তো আর রাখবে না তাকে। কণিকার বাড়ির তিক্ত অভিজ্ঞতা সে তো ভোলেনি। ভাঙা ডান হাতখানা তার আজও কমজোরি। ভারী জিনিস তুলতে পারে না। সে মুখে একটু হাসির ছদ্মবেশ ধারণ করে বলল, না না, শরীর ঠিক আছে।
মোহিনীর বয়স পনেরো। বিপজ্জনক বয়স। এই বয়সে মেয়েরা বড় চঞ্চল হয়। চয়ন এসব জেনেছে টিউশনি করতে করতেই। তাই আজকাল সে তার কিশোরী ছাত্রীদের চোখের দিকে চায় না। জীবনের জটিলতা যত কম হয় ততই ভাল।
মোহিনী একটু উসখৃস করে এক মিনিট আসছি বলে উঠে গেল।
কিছুক্ষণ বাদে মোহিনীর মা এলেন। হাতে এক গ্লাস কম্যান আর দুটো টোস্ট।
মোহিনী বলছিল তোমার নাকি কি হয়েছে?
চয়ন বড় অপ্রতিভ হয়ে বলে, তেমন কিছু না। পিছল রাস্তায় একটা আছাড় খেয়েছি।
খুব লেগেছে?
সামান্য। জামাকাপড় নষ্ট হয়েছে জলকাদায়। অবশ্য শুকিয়েও গেছে এতক্ষণে।
শরীর ভাল আছে তো?
আছে।
এটা খেয়ে নাও।
চয়ন কৃতজ্ঞতায় মরমে মরে গেল। কিন্তু খিদের মুখে কী যে চমৎকার লাগল তার খাবারটুকু! বুকটা ঠাণ্ডা হল, জুড়িয়ে গেল।
পড়ায় সে ভালই। ইংরজি আর অঙ্ক দুটোই ভাল পারে বলে টিউশনির অভাব হয় না। তবে বেশী টাকা দাবী করতে ভয় পায়।
০০৩. নতুন কেনা সুটকেসটা
নতুন কেনা সুটকেসটার দিকে চেয়ে ছিল বীণাপাণি। দেখতে হুবহু চামড়ার জিনিস। কিন্তু বীণাপাণি জানে জিনিসটা পিচবোর্ডের। ওপরটা ঠিক চামড়ার মতো রং করা। সস্তার জিনিস। নিমাই তাতে পাটে পাটে নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিল।
বীণাপাণির খুব অম্বলের রোগ আজকাল। সকালবেলাতেও টক জল বমি হয়েছে খানিকটা। বুক এখনও ঢাক ঢক। করছে তেলগোলার মতো অম্বলে। মাথাটা ঠিক থাকছে না। শরীরটা দুর্বল লাগছে। বিছানায় বসে সে একদৃষ্টে নিমাইয়ের সুটকেস গোছানো দেখছে। শুধু স্যুটকেস নয়, নিমাই গোছাচ্ছে তার আখের। এ দেশে মেয়ে হয়ে জন্মানো যে কত বড় পাপ তা বীণাপাণির চেয়ে ভাল আর কে জানে! মাথাটা ধরে আছে খুব। চোখ ঝাপসা বোধহয় চোখের জলেই হবে। কিন্তু কান্না নয়। বরং বুকে উথলে উঠছে রাগ। রাগের সাপ ছোবলাচ্ছে। বিষ ঢালছে শরীরময়।