সে ভারতবর্ষের এক সরল, গরিব, উদ্বিগ্ন মানুষ। সে একজন গ্রামবাসী হিসেবেই যাবে রাষ্ট্রনায়কদের কাছে? বলবে আমি রাজনীতি জানি না, আমি জানি না অর্থনীতির কূট তত্ত্ব, আমি শুধু চাই পৃথিবীর গভীর অভ্যন্তরে তার হৃৎপিন্ডের যে স্পন্দনটুকু আজও ধুকধুক করছে তা অব্যাহত হোক। মানুষ তাকে বোকা বলবে, দুয়ো দেবে, প্রত্যাখ্যান করবে। করুক। সেই অপমান তার গায়ে লাগবে না।
একসময় বহুদিন ধরে যাতায়াত করেছে বলে স্টেশনটা ভুল হল না তার। ভুল হওয়ার কথা ছিল। প্রবল বৃষ্টিতে বাইরেটা বড়ই আবছা এবং সে ছিল গভীরভাবে অন্যমনস্ক। তবু স্টেশনের বেড়ার গায়ে মস্ত কাঠচাপা গাছটাই বোধ হয় চেনা দিল তাকে। যেন বলে উঠল এই যে অনেকদিন বাদে! এসে এসো। সে উঠল স্বপ্লেখিতের মতো, বাঙ্ক থেকে নাইলনের ব্যাগটা নামিয়ে ছাতা খুলে প্ল্যাটফর্মে পা দিল। বৃষ্টির ঝরোখা ঘিরে ফেলল তাকে।
তখন ছাতা জুটত না। কচুপাতা বা টোকা আটকাতে পারত না বৃষ্টিকে। ভেজা গায়ে ট্রেনে উঠে কলকাতায় যেত সে। সারা দিন ভেজা জামা প্যান্ট গায়েই শুকোত। সর্দি লাগত না। গরিবের শরীর সব সয়ে নিত। এক জোড়া রবারের সস্তা জুতো থাকত তার। শীতে গ্রীষ্মে পরত। ছিঁড়ে গেলে সেলাই করে নিত, সোল ক্ষয় হয়ে গেলে ভিতরে ভরে নিত পিচবোৰ্ড, যতদিন পারত সেই জুতোতেই চালিয়ে নিত। নিতান্ত অকেজো হয়ে গেলে, আর এক জোড়া কিনতে যে সময় লাগত বাড়তি টাকা জোগাড়ের জন্য তখন খালি পায়ে হাঁটতে হত মাইলের পর মাইল। তবু সেই সব দিনের স্মৃতি কেন কেবলই আনন্দের শিহরণ বয়ে আনে আজও।
স্টেশনে পা দিয়ে ঠিক সেইরকমই মনে হল তার। সব পুরনো দিন ফিরে এল বুঝি।
স্টেশনে লোকজন নেই বললেই হয়। স্টেশনের শেড-এর তলায় সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। তাড়াহুড়ো নেই। সে কিছুক্ষণ শিউরানো রোমকূপ নিয়ে অনুভব করল তার হারিয়ে যাওয়া নিজেকে। শৈশবের সে এসে কি অলক্ষে হাত ধরেছে আজকের তার?
তাড়া নেই। কিছুমাত্র তাড়া নেই। খুব ধীরে ধীরে চুমুকে চুমুকে চা খাওয়ার মতো সে তার চারদিককার সব কিছুকে গ্রহণ করছে ভিতরে। উপভোগ করছে। ধীর পায়ে সে বেরিয়ে এল স্টেশনের বাইরে, যেখানে দোকানপাট, রিক্সা-ভ্যান গাড়ি, বাসের আড্ডা। আজ বড় ফাঁকা-ফাকা। আজকাল শীতলাতলা বিষ্টুপুরের বাস হয়েছে। এক টানে নিয়ে যায়।
একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দোকানীকে জিজ্ঞেস করল সে, শীতলাতলা বিষ্টুপুরের বাস কোথা থেকে ছাড়ে?
এই চৌপথী থেকেই ছাড়ে। আজ কি আর বাস পাবেন! সকালের দিকে দুখানা গেছে। ফেরেনি এখনও।
বাসের অনিশ্চয়তায় সে একটুও ঘাবড়ে গেল না। মনে হল এটাই যেন ঈশ্বরের অভিপ্রেত, সে বরাবর হেঁটে স্টেশনে এসেছে গেছে। আজও তাই যাবে।
স্টেশনের চৌহদ্দি পেরিয়ে যখন নির্জন ফাঁকা রাস্তায় এসে পড়ল তখন নিবিড় ঝিমঝিম, অনুত্তেজক বৃষ্টি ঘিরে ধরল তাকে। ঘিরে ধরল ভেজা মাটির গন্ধ। ঘিরে ধরল গাছপালা। এরা কি জানে যে, সে এদের বন্ধু? সে পৃথিবীর প্রতিটি বৃক্ষের বন্ধু, কীটপতঙ্গের বন্ধু, তৃণভূমি, নদী, পশুপাখি সকলের বন্ধু সে। কিন্তু এরা কি টের পায় তা?
কবে পিচ হয়েছিল, তারপর গরুর গাড়ি, ট্রাক আর বাসের ধাক্কায় কবে উড়ে গেছে রাস্তার মসৃণতা। মাঝে মাঝে ডোবার মতো বড় বড় গর্ত। জলে ভরভর। সে জল বাঁচিয়ে চলার চেষ্টাই করল না। ছেলেবেলার মতো জল ভেঙে, খানাখন্দ ভেঙে, কাদা ঘেঁটে হাঁটতে লাগল। একদিন সে শহরের বাস ঘুচিয়ে চলে আসবে গায়ে। মাটি মাখবে, ভাব করবে পৃথিবীর সঙ্গে।
আলপথ ধরে গেলে রাস্তা অনেক কম হত। কিন্তু সে দেখল, ক্ষেতগুলো জলে ড়ুবে আছে। পিছল আল ধরে যাওয়া ঠিক হবে না। ক্রমে নিবিড় থেকে নিবিড়তর গায়ের মধ্যে চলে যেতে যেতে তার দুখানা চোখ রূপমুগ্ধ সম্মোহিত হয়ে যেতে লাগল। ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের চমৎকার পরিচ্ছন্ন কান্ট্রিসাইড এ নয়। তবু এই দীনদরিদ্র, শতাব্দীকাল পিছিয়ে থাকা পল্পী বাংলার সঙ্গে তার এখনও নাড়ীর টান।
সে যখন গাঁয়ের কাছাকাছি হচ্ছিল, যখন দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল সুপুরি আর নারকেল গাছের জড়ামরি তখন শীতলাতলা বিষ্টুপুরে বটতলার অনতিদূরে ঘোষপাড়ার নাবালের ধারে বহু মানুষ বৃষ্টির মধ্যেও জমা হয়েছে। নাবালে অনেক জল। তার মধ্যে উল্টো হয়ে অর্ধেক অন্তর্জলিতে পড়ে আছে একটা লাশ। মুণ্ড সমেত মাজা অবধি ড়ুবে আছে জলে। পায়ের চটি আর কালো প্যান্টওলা দুখানা পা ছড়িয়ে আছে কাদামাখা ডাঙায়। গায়ের সবুজ জামাটা বাতাসে একটু ফুলে বেলুনের মতো ভেসে আছে জলের ওপর।
যারা দেখছিল তাদের কারও মুখে কথা নেই। তারা হয়তো কেউ জানে, কেউ হয়তো জানে না, কেউ জেনেও জানে না, এরা ভয় পেয়েছে। অস্তিত্বের ভয়ংকর অনিশ্চয়তার একটি দৃশ্য তাদের চোখের সামনে। কত আদরের শরীর, কত তাচ্ছিল্য ও অবহেলায় জলকাদায় পড়ে আছে মরা কুকুর-বেড়ালের মতো। এদের অনেকের আজ দুপুরের ভাত মুখে রুচবে না, রাতে ঘুম হবে না ভাল করে। এরা অনেকেই এধন কিছু দিন খুব ভয়ে ভয়ে থাকবে। চমকে উঠবে বাতাসের শব্দে। টিনের চালে বেড়াল লাফ দিলেও কেঁপে উঠবে ভয়ে।
একটু-আধটু ফিসফাস চলছে। কেউ কেউ বলছে খুন-হওয়া লোকটা রামজীবন বা নপাড়ার দু মণ্ডল। কেউ একজন বলল, মনে হচ্ছে গদাই।
গণার সাইকেলের দোকানের বাচ্চা ছেলে কালু অবশ্য জানে। কিন্তু মরে গেলেও সে মুখ খুলবে না। শেষ রাতে সে পেস্থাপ করতে উঠেছিল। ঝাঁপ খুলে বেরিয়েই সে বটতলায় একটা চেঁচানি শুনতে পায়, বাবা রে: তারপর কে একটা খিস্তি দিয়ে বলে উঠল, চোপ শুয়োরের বাচ্চা, মুখে ইয়ে ভরে দেবো…