বৃদ্ধটি তার মৃত ভাইকে কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে আদর বা আশীর্বাদ করলেন। তারপর শিখার কাছে গিয়ে একটু বসলেন পাশের সোফায়। বড় ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল বৃদ্ধকে। শিখার সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তা হচ্ছিল। মৃদু স্বরেই।
শবর বলল, তোর শাশুড়ি বেশ শক্ত ধাতের মানুষ। স্বামী মারা যাওয়ায় ভেঙে পড়েনি তো।
মধুমিতা একটু মুখ বিকৃত করে বলল, দু’জনের সম্পর্ক তো ছিল বিষ। কঁদবে কী, মনে মনে হয়তো খুশিই হয়েছে। যা হাড়-জ্বালানো মানুষ ছিলেন শ্বশুরমশাই, বাব্বাঃ।
বাসুদেবকে নামানো হচ্ছে নীচে। একবার মৃদু হরিধ্বনি সহকারে খাট উঠে গেল কয়েকজনের কাঁধে, শবর লক্ষ করল গোপালও কাধ দিয়েছে। ঘনঘন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছিল। দরজার সামনে একটু থমকাল শববাহকেরা। তারপর ভিড়টা বেরিয়ে গেল।
ধীরে ধীরে বেশ ফাঁকা হয়ে গেল ঘর।
শবর শিখার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
শিখা একদা সুন্দরী ছিলেন, এখনও আছেন। বয়স কম করেও পঞ্চান্নটঞ্চান্ন তো হবেই, বেশিও হতে পারে। কিন্তু এখনও বেশ ছিপছিপে এবং মুখশ্রীতে বার্ধক্যের বলিরেখা বা চামড়ার শিথিলতা নেই। বয়সের অনুপাতে তাকে বেশ কমবয়সিই লাগে।
শিখা মুখ তুলে বললেন, তুমি কি এখনই চলে যাবে?
হ্যাঁ মাসিমা, জরুরি কাজ আছে।
মাঝে মাঝে একটু খোঁজ নিয়ো। বড্ড একা হয়ে গেলাম তো!
বুড়ো মানুষটি শূন্য দৃষ্টিতে বসে ছিলেন। একথা শুনে বললেন, একা কেন বউমা, তোমার তো জনের অভাব নেই।
শিখা যেন একটু অস্বস্তি বোধ করলেন।
শবর আর দাঁড়াল না। ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বলল, চলি, মাসিমা। লিফটেই নীচে নেমে এল সে। শববাহকদের আগেই। কারণ ওরা সিঁড়ি বেয়ে নামছে। দেরি হবে। নীচে ফটকের সামনে পাড়ার লোকজনের একটু জটলা, ফুল দিয়ে সাজানো কাঁচের গাড়ি ঘিরে ভিড়।
৩. বড় চাকরি করার মস্ত অসুবিধে
বড় চাকরি করার একটা মস্ত অসুবিধে, ছুটির দিন বলে কিছু নেই। এমনকী শনি রবিবারেও এমন কিছু অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা পার্টি থাকে যার সঙ্গে কোম্পানির স্বার্থ জড়িত। আরও একটা অসুবিধে, সব সময়েই যেন কোম্পানির নানা দায়দায়িত্ব ঘাড়ে ভর করে থাকে।
শঙ্কর বসুর এটা তিন নম্বর চাকরি। সেলস ইঞ্জিনিয়ার থেকে এখন রিজিওন্যাল ম্যানেজার। রিচি রোডে মস্ত ফ্ল্যাটে বসবাস। চারটে টেলিফোন। ব্যাঙ্কে মোটামুটি ভদ্রস্থ টাকা জমে যাচ্ছে। ঘরে আধুনিক আসবাবপত্র, গ্যাজেটস এবং ঝি-চাকরের অভাব নেই।
অভাব ব্যাপারটা অবশ্য এইসব বাস্তব সাফল্যের ওপর নির্ভর করে না। অভাব এক ধরনের ধারণা, এক ধরনের অস্থিরতা, হয়তো এক ধরনের ভ্যাকুয়াম।
আজ ছুটির দিন নয়। নটার মধ্যে অফিসে পৌঁছতে হবে। হবেই। সকাল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে সাড়ে ছ’টা অবধি একটু জগিং ও হাটা শেষ করে বাড়ি ফিরেই দাড়ি কামানো আর স্নানের জন্য পনেরো মিনিট ব্যয় করতে হয়। সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে তিনটে খবরের কাগজে চোখ বোলানো। তার পরেই মাপা ব্রেকফাস্ট। সওয়া আটটায় মারুতি এস্টিমে হুস করে বেরিয়ে যাওয়া। তারপর সারাদিন শঙ্কর বসু আর ব্যক্তিগত শঙ্কর বসু নয়। নয় রীণার স্বামী বা পরমার বাবা। সে তখন কেবলই নিকলসনের বড় সাহেব।
আজ সকাল সওয়া সাতটায় শঙ্কর বসুর ব্যস্ত সকাল কিছুটা মন্থর করে দিল খবরের কাগজের একটি ছোট খবর। খবরটা বেরিয়েছে খেলার পাতায়, ডিটেলস বিশেষ নেই। বাসুদেব সেনগুপ্ত বড় খবর হওয়ার মতো লোকও ছিল না। স্কাউড্রেলটা চার দিন আগে মারা গেছে। হার্ট অ্যাটাক। “তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, দুই পুত্র, এক কন্যা ও অসংখ্য গুণমুগ্ধ…”
গুণমুগ্ধ? গুণমুগ্ধ? শঙ্কর ভ্রু কোঁচকাল। শঙ্করের মুখে খারাপ কথা কদাচিৎ কেউ শুনেছে। তার রুচিবোধ প্রবল। তবু আজ শুয়োরের বাচ্চা কথাটা যেন আপনা থেকেই। তার নিঃশব্দ জিবের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এল। খাসবায়ুর সঙ্গে সেটা শব্দ হয়ে অস্ফুটে উচ্চারিতও হয়ে গেল। সামান্য লজ্জিত হল শঙ্কর।
ঘড়িতে পৌনে আটটা। বেশ দেরিই হয়ে গেছে। আজ ব্রেকফাস্টটা স্কিপ করবে নাকি?
লিভিং রুমের প্রিয় রিক্লাইনিং চেয়ারটি ছেড়ে শঙ্কর উঠে পড়ল। নাউ টু ড্রেস আপ। এই ড্রেস আপে তার কিছু সময় লাগে। এমন নয় যে সে খুব সাজগোেজ করে। কিন্তু ভারিক্কি চাকরির কিছু দাবি থাকেই। প্রায় রোজই অফিসের পর কনফারেন্স বা মিটিং বা বড়কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক থাকেই। পোশাকটা সাবধানে না করলে কিছু ভ্রু কুঞ্চিত হয়।
বেশির ভাগ দিনই সুট। আজও তাই। নেভি ব্লু ট্রপিক্যাল সুট টাই সহযোগে পরে যখন ডাইনিং হলে ঢুকল তখন আটটা দশ। হঠাৎ আজ তার একটু গরম লাগছে। সে বেয়ারা। রামুকে বলল, এয়ারকুলারটা চালিয়ে দে তো। দুটোই চালা।
দুটো এয়ারকুলারে ঘর ঠান্ডা হচ্ছিল বটে, কিন্তু শঙ্করের মনে হল, এটা ঠিক সেই গরম নয়। বহুদিনকার পুরনো একটা রাগ আর অপমানই ঝটকা মেরেছে আজ। শরীরে মৃদু একটা রি-রি ভাব। রীণার চলাফেরা আজও স্বপ্নের মতো। ওর হাঁটা আজও ভেসে যাওয়ার মতো সাবলীল। রীণার পুতুল পুতুল চেহারা অনেক পালটে গেছে বটে। কিন্তু এখনও রীণাকে ঠিক রিয়েল বলে মনে হয় না শঙ্করের।
রীণা ঘরে এসেই ভ্রু কুঁচকে বলল, এ কী। আজ তো গরম নয়। এয়ারকুলার চালিয়েছ কেন রামু?