ছ’তলায় এসে বাসুদেব বুকের মাঝখানে ব্যথাটা টের পাচ্ছিলেন। মৃদু কিন্তু নিশ্চিত। বুকে দূরাগত দামামার মতো একটা আওয়াজ।
এবং আচমকাই চোখে একটা অন্ধকার পরদার মতো কিছু ড্রপসিনের মতো পড়েই উঠে গেল। সমস্ত বুদ্ধি, বৃত্তি, যুক্তি, সাহস ভেদ করে একটা ভয় বাসুদেবকে ভালুকের মতো জাপটে ধরল। তার কিছু হচ্ছে? সময় এসে গেল নাকি?
সামনে যে দরজাটা পেলেন তারই ডোরবেল চেপে ধরলেন তিনি। ভিতরে ডিংডং আওয়াজ হল। বারবার বেল টিপলেন তিনি। বারবার আওয়াজ হল। বৃথা। কেউ নেই। প্রতি তলায় তিনটে করে ফ্ল্যাট। তিনটে দরজারই বেল টিপলেন বাসুদেব। তার তেষ্টা পাচ্ছে। তাঁর এখনই শুয়ে পড়া দরকার।
মেঝেতেই শুয়ে পড়বেন কি? ডাক্তার তাকে বলেছিল, হার্ট অ্যাটাক টের পেলেই শুয়ে পড়তে। যখন যে-কোনও অবস্থাতেই শুয়ে পড়াই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা।
কিন্তু বাসুদেব তা পারলেন না। মেঝেয় শোবেন? বাসুদেব সেনগুপ্ত কি তা পারেন? অহং যে এখনও মরেনি। তিনি অসহায়ের মতো সিঁড়ির চাতালে শুয়ে পড়লে যে লোকে। হাসবে।
ছ’টা তলা পেরিয়ে এসেছেন। সাত পেরিয়ে আটে উঠে যেতে পারলে আর ভাবনা কী?
কিন্তু আরও দুটো তলা যেন এভারেস্টের মতো উঁচু মনে হচ্ছে এখন।
বাসুদেব বারবার চোখে আলো আর অন্ধকার দেখছেন। বুকে মাদল বাজছে। ক্রমে ক্রমে পুঞ্জীভূত হচ্ছে বুকের ব্যথা। বাসুদেব রেলিং আঁকড়ে ধরে দুটো সিঁড়ি ভাঙতেই ককিয়ে উঠলেন ব্যথায়। তার কষে ফেনার মতো কী যেন বুজকুড়ি কাটছে। মাথা টলে যাচ্ছে। হাত ও পা শিথিল আর শীতল হয়ে যাচ্ছে যে! তিনি প্রাণপণে ডাকতে চেষ্টা করলেন, শিখা! শিখা। শিখা…
সিঁড়ি দিয়ে কে নেমে আসছিল। খোলা চোখে চেয়ে ধীরে ধীরে বাসুদেব সিঁড়িতে পড়ে যাচ্ছেন। চেঁচিয়ে বললেন, বাঁচাও….
যে নেমে এল তার মুখটা চিনতে পারলেন বাসুদেব। তার দিকে চেয়ে আছে। বাসুদেব হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। ধরো আমাকে ধরো। সে ধরল না। ধীর পায়ে নেমে গেল পাশ কাটিয়ে। বাসুদেব গড়িয়ে পড়লেন সিঁড়িতে। চোখে যবনিকা নেমে এল।
২. চেনা মানুষের মৃত্যুসংবাদ
চেনা মানুষের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া মানেই একটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যাওয়া। যেতে হবে, সময়োচিত শোকজ্ঞাপন করতে হবে। এড়াতে না পারলে শ্মশানবন্ধু হতে হবে। আনঅ্যাভয়েডবল।
বাসুদেব সেনগুপ্তের মৃত্যুসংবাদটা শবর পেল সকালে, কেফাস্টের সময়। বাসুদেব যে তার খুব প্রিয় বা শ্রদ্ধেয় মানুষ ছিলেন এমন নয়। কিন্তু সন্ড কটা এড়ানোও যায় না। তার পিসতুতো বোনের শ্বশুর। তা ছাড়া শবর যে ক্লাবে ফুটবল খেলত সেই ক্লাবের একজন বিশিষ্ট প্রাক্তন খেলোয়াড় ও কর্মকর্তা। ভালই চেনাজানা ছিল একটা সময়ে।
ব্রেকফাস্টটা পুরোটা খেতে পারল না শবর। উঠে পড়ল। যেতে হবে।
পুলিশ জিপে বেশি সময় লাগল না। লিফটে আটতলায় উঠে দেখল বাসুদেবের ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই রয়েছে। বিস্তর লোক জমা হয়েছে ঘরে। ক্লাবের লোকেরা এসেছে, বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়, আত্মীয়স্বজন তো আছেই। ঘরে থমথমে একটা ভাব। সামনের ঘরেই একটা ডিভানে বাসুদেবকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ফুল, মালা, ধূপকাঠি, বিভিন্ন ক্লাব বা কর্মকর্তাদের দেওয়া ফুলের চাকা ডিভানের গায়ে দাঁড় করানো।
ঘটনাটা দুঃখজনক। ফোনে বাসুদেবের বড় ছেলে বলেছিল, লিফটেনা উঠে বাসুদেব হেঁটে উঠছিলেন। কমজোরি হার্ট ওই পরিশ্রম নিতে পারেনি। সাততলার গোড়াতেই বাসুদেব হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান। রাত দশটা অবধি কেউ ঘটনাটা টের পায়নি। কারণ ফ্ল্যাটবাড়িটার অধিকাংশই খালি, লোক এখনও আসেনি৷ দশটাতেও স্বামী না ফেরায় শিখাদেবী বেরিয়ে এসে লিফটে নীচে নামেন। দারোয়ান কিছু বলতে পারেনি। ছ’তলার নন্দীবাবু রাত সাড়ে দশটায় ফিরে বাসুদেবকে দেখতে পান। তিনিই শিখাকে খবর দেন।
ঘরে কান্নাকাটি তেমন কিছু নেই। বাসুদেবের স্ত্রী সোফায় বসে আছেন, দুপাশে দু’জন মহিলা। শিখার মুখখানা থমথমে এই মাত্র। ছেলে অর্কদেব আর বুদ্ধদেব একটু গম্ভীর মাত্র। মেয়ে সুপর্ণা একটা সোফায় বসে চোখে রুমাল চাপা দিয়ে মাথা নিচু করে আছে।
শবর শিখার কাছেই এগিয়ে গেল।
স্যাড, মাসিমা।
শিখা বিমর্ষ গলায় বলল, কী করে যে হল!
উনি লিফট থাকতে হেঁটে উঠছিলেন কেন?
কী করে বলব? শরীর নিয়ে খুব বড়াই ছিল তো? হয়তো শক্তি পরীক্ষা করতে চাইছিল।
স্ট্রেঞ্জ!
একজন ক্রনিক হার্ট পেশেন্ট লিফট থাকতেও হেঁটে আটতলা উঠতে চাইবে কেন সেটা একটা জরুরি প্রশ্ন। কিন্তু সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামানোর মানে হয় না।
একজন বিরলকেশ ত্রিশ-বত্রিশ বছরের মজবুত চেহারার লোক দরজার কাছাকাছি দাঁড়ানো। লোকটা একটু এগিয়ে এসে বলল, লিফটটা সার্ভিসিং হচ্ছিল বলে উনি হেঁটে উঠছিলেন। আমাদের তো উনিই খবরটা দিলেন যে, লিফটটা সার্ভিসিং হচ্ছে।
শবর বলল, ও।
লোকটা উপযাচক হয়েই বলল, আমরা অবশ্য নীচে নেমে সার্ভিসিং-এর লোকদের দেখতে পাইনি। তবে লিফটের দরজাটা খোলা ছিল।
আপনি কি এ বাড়ির ফ্ল্যাটওনার?
হ্যাঁ। আমি চারতলায় থাকি। ইন ফ্যাক্ট বোধহয় আমরাই ওঁকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখতে পাই। উনি বেশ ঘামছিলেন আর হাফাচ্ছিলেন। আমরা নামবার সময় ওঁর কথাই আলোচনা করছিলাম।
আমরা মানে কারা?