মাসিমা! আপনি চুপ করুন! আপনি বড় ভেঙে পড়ছেন!
বাবা, না। বলতে দাও। নিজের মুখে সব বলতে দাও আমাকে।
প্লিজ মাসিমা।
না শবর, আজই তো আমার পরীক্ষা। শোনো, মন দিয়ে শোনো।
বলুন শুনছি।
ওঁর ওই প্রাণঘাতী ডাক এখনও আমার কানে লেগে আছে। শিখা… শিখা… শিখা…! ওই ডাক শুনে আমি আর স্থির থাকতে পারিনি। আসছি গো, আসছি’ বলে চিৎকার করলাম, গলা দিয়ে স্বরই বেরোল না। দৌড়ে নেমে গেলাম ছ’তলায়। উনি সিঁড়ির গোড়াতেই পড়ে ছিলেন। মুখ টকটক করছে লাল। হাঁফ ধরে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হাঁ করে প্রাণপণে শাস টানার চেষ্টা করছেন। ঘোলাটে চোখ। আমাকে দেখে একটা অসহায় হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাতটা নেতিয়ে পড়ে গেল।
শিখা একটু থামলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার হাঁফ ধরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে রইলেন। তারপর আঁচলটা সরিয়ে খুব ধীর গলায় বললেন, আমি কী করলাম জানো?
বলুন মাসিমা।
আমি ওঁর পায়ের কাছে বসে, দু’খানা পা বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ছাড়ো, এই পাপ-দেহ ছেড়ে যাও। ওগো, মুক্ত হও, মোচন করো পার্থিব বন্ধন। দেহের দাস, কর্মফলে ক্লেদাক্ত মন জীর্ণ বসনের মতো ফেলে যাও বিমুক্ত আত্মা। নীড় ছাড়ো অনিকেত, দেহ ছাড়ো অশরীরী, মায়া ছাড়ো মোহাতীত। চোখের জলে ভেসে সেই আমার শেষ পুজো তাকে। ধীরে ধীরে শরীরের সব কম্পন থেমে গেল। আমি ওঁকে প্রণাম করে উঠে এলাম। তারপর ঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম ওঁর মৃত্যুসংবাদের জন্য।
ঘরে অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এল। কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। শিখা অনেকক্ষণ আঁচলে মুখে ঢেকে রইলেন। তারপর ধীরে মুখের ঢাকনাটা সরিয়ে একটু হাসলেনও, তোমাদের পেনাল কোড আমাকে আর কী সাজা দিতে পারে শবর?
শবর একটু হাসল।
শিখা মৃদুস্বরে বললেন, সাজা কাকে বলে তা কি জানো শবর? জানো জ্বালা? জানো গ্লানি?
শবর উঠে দাঁড়াল। মৃদুস্বরে বলল, আসি মাসিমা।
এসো বাবা।
শবর দরজাটা খুলে বাইরে পা দিয়ে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখল। যেন নিজের ধ্বংসস্তৃপের মধ্যে বসে আছেন শিখা।
শবর দরজাটা খুব সাবধানে বন্ধ করে দিল। তারপর ধীর পায়ে লিফটের দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে আনমনে নামতে লাগল।