জানি মাসিমা।
আমি ওঁকে কতবার বলেছি, এভাবে বঞ্চিত করতে নেই, তাতে ভাল হয় না। উনি তো আমার কথাকে কখনও মূল্য দেননি।
শঙ্কর বসুর কথা বলুন।
হ্যাঁ। সে বেচারাকে যখন ডেকে আনালাম তখন দেখল ম একটা জীবন স্ত্রীকে রাহুর গ্রাসে সমর্পণ করে লোকটা ভিতরে ভিতরে কেমন ক্ষয়ে গেছে। অত বড় চাকরি, অত টাকাপয়সা, কিন্তু মুখখানা যেন শোকাতাপা। বড় কষ্ট হয়েছিল মানুষটার জন্য। আর অজু! শঙ্করবাবুর কথা থেকে জেনেছিলাম, অজুকে তিনি কিছুই দেবেন না। ছেলেটার জন্য আমার চিন্তা হয়েছিল। একটা পলিসির নমিনি ছেলেটাকে করা হয়েছিল বটে, কিন্তু ওরকম খ্যাপা মানুষের তো মতিস্থিরতা ছিল না। কবে রেগে গিয়ে নমিনি বদলে দেবেন। তা ছাড়া ম্যাচুরিটিরও তো দেরি ছিল। ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটটা নিয়েও ওই একই কথা। হয়তো কখনও সিদ্ধান্ত বদল করে ফ্ল্যাটটা বেচেই দিলেন কাউকে। ওঁর তো রাগের কোনও ঠিকঠিকানা ছিল না।
আর তাই–?
শিখা একটু চুপ করে রইলেন। তাঁর দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসছিল। মৃদু স্বলিত কণ্ঠে বললেন, ওঁর চলে যাওয়ার দরকার ছিল হয়তো। গিয়ে ভালই হয়েছে। কী বলো?
আমি কী বলব মাসিমা, আপনি বলুন।
শিখা উঠে ভিতরের ঘরে গেলেন। ফিরে এলেন একগাদা মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে। শবরের সামনে সেন্টার টেবিলের ওপর সেগুলো রেখে বললেন, দেখো। উলটেপালটে দেখো।
শবর ভ্রূ কুঁচকে বলল, এ তো আপনার মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখছি।
হ্যাঁ, প্রায় ছ’মাস আগে অসুখটা ধরা পড়ে। ডাক্তার জানে আর আমি। আর কাউকে জানাইনি। ওঁকে বা ছেলেমেয়েকে কখনও বলিনি।
কেন মাসিমা? এ তো টারমিনাল ডিজিজ।
ও কথাটা ডাক্তারদের মুখে অনেকবার শুনেছি, তাই মানে জানি৷ হ্যাঁ বাবা, মারক অসুখ।
চিকিৎসা?
শিখা হাসলেন, ক্যান্সারের আর কী চিকিৎসা বাবা? কেমোথেরাপি না কী ছাইভস্ম করতে চেয়েছিল, আমি রাজি হইনি। ওসব করে কী লাভ বলো? মরতে যে আমার একটুও অসাধ নেই।
শবর রিপোর্টগুলোয় চোখ বুলিয়ে রেখে দিল।
রোগটা হওয়ার পর বুঝেছিলাম, আমি যদি ওঁর আগে যাই তা হলে অনেক সমস্যার আর সমাধান হবে না। অনেক মানুষের বুকে জ্বালাপোড়া রয়ে যাবে। থেকে যাবে অনেক অনিশ্চয়তা। বুঝেছ?
হ্যাঁ মাসিমা। সব কিছুই মিলে যাচ্ছে।
মিলবেই তো। সবকিছু মিলে যাবে। যে দুটো লোক লিফট সারাবার অছিলায় এসেছিল তুমি তাদের জন্মেও খুঁজে পাবে না। আর যদি পেয়েও যাও, ওদের গলা কেটে ফেললেও কথা বের করতে পারবে না।
বুঝেছি।
আর সেই লোক দুটোর নাম বা পরিচয় আমার সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে, এ মুখ দিয়ে তা বেরোবে না কখনও।
আমি জানি, বুলডগের মতো অনুগত আপনার কিছু লোক আছে, যারা আপনার জন্য প্রাণ দিতে পারে।
হ্যাঁ বাবা। আমার নিঃসঙ্গ জীবনে এইসব লোকই তো আমাকে সঙ্গ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। নিরন্ন, দুঃখী, জর্জর সব মানুষ যাদের ভালর জন্য আমি সামান্য সামর্থ্যে যতটুকু পারি করেছি।
শিখা একটু চুপ করে রইলেন। তারপর চোখের অবাধ্য ধারা আঁচলে মুছবার একটা অক্ষম চেষ্টা করে বললেন, ওদের খোঁজ ছেড়ে দিয়ে ভালই করেছ শবর। ওরা কী করেছে তা ওরা ভাল করে জানেই না। ওরা শুধু আমার হুকুম তামিল করে চলে গেছে।
বুঝেছি মাসিমা।
তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। খুবই বুদ্ধিমান। জীবনে খুব উন্নতি করবে বাবা।
কেন লজ্জা দিচ্ছেন মাসিমা। আমি আজ এসব কথা শুনতে তো আসিনি।
শিখা নিমীলিত চোখে তার দিকে চেয়ে গভীর হাহাকারের মতো একটা শ্বাস ছাড়লেন। সেই শ্বাসে কান্নার কম্পন ছিল। শিখা প্রকাশ্যেই চোখের জলে ভেসে যাচ্ছেন। একটু চুপ করে থেকে দূরাগত গলায় বললেন, কী শুনতে চাও শবর?
আপনি বলতে না চাইলে—
কান্নার মধ্যেও শিখা সামান্য একটু হাসলেন। অদ্ভুত দেখাল তখন মুখখানা।
প্রায় ফিসফিস করে বললেন, সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আমি সিঁড়িতে ওঁর চটির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। নির্জন ফাঁকা বাড়ি, সব শব্দই পাওয়া যায়। একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে তিনতলা… উনি ধীরে ধীরে উঠে আসছেন। উনি উঠছেন আর বুকের মধ্যে ওঁর পায়ের শব্দ যেন দুম দুম করে ধাক্কা মারছে। এক একবার ইচ্ছে হচ্ছিল, চিৎকার করে বলি, ওগো! উঠো না উঠো না! এ সবই আমার ষড়যন্ত্র! আমি এক্ষুনি নেমে গিয়ে লিফট চালু করছি।… নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে নিজেকে সামলেছি। নিজেকেও বলেছি, একটুক্ষণের জন্য পাষাণী হ… এই একটা পাপ মাথায় নে, তাতে অনেক পাপের স্খলন হবে। ও দোতলা থেকে তিনতলা উঠল… চারতলা… কার সঙ্গে যেন হাঁফধরা গলায় কথা বলল… তারপর তিনতলা পেরিয়ে চারতলা… পায়ের শব্দ অনেক শ্লথ হয়ে গেল। বুঝতে পারছিলাম সে টান ধরছে। আর পারছে না। কিন্তু জেদি, অহংকারী মানুষ। ছাড়বেও না। পাঁচতলা পেরিয়ে ছ’তলায় উঠতে যেন যুগ পেরিয়ে যাচ্ছিল। পারছে না। কিছুতেই পারছে না। আমি আটতলার চাতালে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেসে যাচ্ছি। চোখের জলে আমার বুক ভেসে যাচ্ছিল। এত জোরে দাতে দাঁত চেপে ধরেছিলাম যে ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে পড়ল। রেলিং চেপে ধরেছি প্রাণপণে। আর ওদিকে ও উঠছে! কী ক্লান্ত পায়ের শব্দ। কী ভয়ংকর শ্বাসের শব্দ! পাঁচতলা থেকে ছ’তলা কতদূর শবর? কিন্তু সে যেন ওঁর কাছে এক অফুরান পথ। উঠছেন তো উঠছেনই। শেষ অবধি পৌঁছোলেন ছ’তলায়। থামলেন। হঠাৎ শুনলাম ডোরবেল বাজছে। একবার, দু’বার, তিনবার। তারপরই একটা শব্দ। উনি পড়ে গেলেন। তখনই শুনলাম, হাঁফধরা গলায় উনি প্রাণপণে আমাকে ডাকছেন। আমাকেই! শিখা… শিখা… শিখা….! অমনভাবে কতকাল ডাকেননি!